হৃদরােগের চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলাে যথাসম্ভব জটিলতা এড়িয়ে, সীমিত খরচে, দ্রুত সঠিক রােগনির্ণয়। দ্রুততম সময়ে রােগ নির্ণয় করা গেলে আর যথাসময়ে রােগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারলে চিকিৎসার সফলতার বিষয়টি অনেকাংশে সহজ হয়ে আসে।
হৃদ্রােগের ক্ষেত্রে আমরা নানান পরীক্ষার নাম শুনে অভ্যস্ত। কখন, কেন, কোন পরীক্ষা করা হয়, এগুলাে সম্পর্কে একটু ধারণা নেওয়া যাক। বিশেষ বিশেষ হৃদ্রােগের জন্য ধাপে ধাপে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়ােজন হতে পারে।
শরীরে একটা ছিদ্রের মাধ্যমে (ইনভেসিভ প্রসিডিওর) কোনাে যন্ত্র প্রবেশ করিয়ে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানাে হয়, সেগুলাের মধ্যে এনজিওগ্রাম বহুল প্রচলিত। কিন্তু যেসব পদ্ধতি বা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীরে যন্ত্র প্রবেশ না করিয়ে পরীক্ষা করা হয়, সেগুলােকে বলা হয় ননইনভেসিভ প্রসিডিওর।
হৃদরােগ যে কেবল বুড়াে বয়সেই হয়, এ ধারণা ভুল। প্রাপ্তবয়স্ক, কিশাের, শিশু, সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু এমনকি গর্ভস্থ ভ্রণের সমস্যাও নির্ণয় করা সম্ভব বিভিন্ন নন-ইনভেসিভ প্রক্রিয়ায়।
সাধারণ ইকোকার্ডিওগ্রাম (স্ক্রিনিং ও ডপলার) ছাড়াও রয়েছে যেমন স্ট্রেস-ইকো, ট্রান্স-ইসােফেজিয়াল (গলায় নল ঢুকিয়ে, অজ্ঞান না করে কেবল অবশ করার স্প্রে প্রয়ােগ করে করা হয়), ভাসকুলার (রক্তনালির), কনজেনিটাল (জন্মগত), নিওনেটাল (নবজাতকের), ফিটাল (গর্ভস্থ শিশুর), ইন্টাঅপারেটিভ (অস্ত্রোপচার চলাকালীন)সহ অত্যাধুনিক ইকোকার্ডিওগ্রাম।
স্ট্রেস ইকোকার্ডিওগ্রাম
হার্ট অ্যাটাকের রােগীর হৃৎপেশির ঠিক কতটা আক্রান্ত, আক্রান্ত পেশি পুনরায় সুস্থ করে তােলা সম্ভব কি না, সে সম্পর্কে জানা যায় স্ট্রেস ইকোকার্ডিওগ্রাম থেকে।
তা থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় পরবর্তী চিকিৎসাপদ্ধতির বিষয়ে। আন্তর্জাতিক পরিসরে এভাবে রােগনির্ণয় স্বীকৃত পদ্ধতি। ভালভের সমস্যার ক্ষেত্রেও জটিলতার মাত্রা নিরূপণে প্রয়ােজন এই পরীক্ষার।
আবার শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে বাইপাস করা কিংবা স্টেন্টিং করা রােগীরও কিন্তু হৃদ্রােগের লক্ষণ পুনরায় দেখা দিতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে রােগীর লক্ষণের সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল মেলে না।
কারণ, মাটির গভীরে গাছের শিকড়ের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশের মতােই হৃদপিণ্ডে ছড়িয়ে থাকে অসংখ্য ক্ষুদ্র রক্তনালি, যেগুলাের রক্তচলাচল ঠিক থাকা বা না থাকাটা সহজে ধরা যায় না।
আর বারবার এনজিওগ্রাম করা হলে বিকিরণজনিত ঝুঁকিতে পড়তে পারেন রােগী, প্রক্রিয়াটি ব্যয়বহুলও বটে। এনজিওগ্রামে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নালির সমস্যা ধরা না-ও পড়তে পারে। এমন ক্ষেত্রেও সঠিক রােগনির্ণয়ের জন্য প্রয়ােজন স্ট্রেস ইকোকার্ডিওগ্রামের।
আবার একজন রােগী হয়তাে হৃদরােগে ভুগছেন না, কিন্তু শরীরে অন্য কোনাে অস্ত্রোপচার করতে হচ্ছে। অস্ত্রোপচারের আগেই শল্যচিকিৎসার দলটি রােগীর হৃদপিণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে কি তা জানতে চান যাতে অস্ত্রোপচারের সময় বা পরে সমস্যা না হয়।
সাধারণ ইসিজি কিংবা ইটিটি থেকে সব সময় সামগ্রিক অবস্থা বােঝা যায় না। সবাই ইটিটি করানাের মতাে শারীরিক অবস্থায় থাকেনও না। তাই উন্নত বিশ্বে স্ট্রেস ইকোকার্ডিওগ্রাম করানাের নিয়ম প্রচলিত।
ট্রান্স-ইসােফেজিয়াল ইকোকার্ডিওগ্রাম
জন্মগত ত্রুটি নির্ণয় ও চিকিৎসায় (অস্ত্রোপচার বা যন্ত্র প্রতিস্থাপন) এই পরীক্ষা আবশ্যক। সাধারণ ইকোকার্ডিওগ্রামের অস্পষ্ট বিষয় নিশ্চিত করতে, ভালভের অবস্থা বুঝতে কিংবা স্ট্রোক, রক্ত জমাট বা অজ্ঞাত সংক্রমণের কারণ উদঘাটন করতে কাজে লাগে ট্রান্স-ইসােফেজিয়াল ইকো।
ভর্তি না হয়েই ৩০-৪০ মিনিট সময়ের মধ্যেই করা যায় এই পরীক্ষা। আধুনিক হাসপাতালে যখন শল্যচিকিৎসক হৃদপিণ্ডের অস্ত্রোপচার করেন, তখনই করা হয় ট্রান্স-ইসােফেজিয়াল ইকোকার্ডিওগ্রাম। ত্রুটি রয়ে গেলে তখনই শল্যচিকিৎসক তা সংশােধন করে নিতে পারেন।
জন্মগত হৃদ্রােগে ভ্রুণের ত্রুটি নির্ণয়ে
গর্ভের সন্তানের হৃদপিণ্ডের গতি অনিয়মিত হওয়া, আগের সন্তানের জন্মগত হৃদরােগের ইতিহাস, কিংবা মায়ের কিছু নির্দিষ্ট জীবাণু সংক্রমণ হয়ে থাকলে ফিটাল ইকোকার্ডিওগ্রাম প্রয়ােজন হয়।
প্রয়ােজনীয়তা থাকলে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই ত্রুটি দেখে নেওয়া ভালাে। প্রয়ােজনে এমন হাসপাতালে প্রসবের ব্যবস্থা করতে হবে, যেখানে সদ্যোজাত শিশুর নিবিড় পরিচর্যার ব্যবস্থা রয়েছে।
এ ছাড়া হৃৎপিণ্ডের জন্মগত ত্রুটি সংশােধনের জন্য শুরুতেই রােগীকে ভর্তি রেখে ইনভেসিভ পদ্ধতি প্রয়ােগের (ক্যাথেটারাইজেশন) প্রয়ােজন পড়তো একসময়, আদৌ ‘অস্ত্রপচার সম্ভব কি না, তা নির্ণয় করতেই এমন ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হতাে।
এখন দশ হাতে করা সাধারণ ইকোকার্ডিওগ্রাম, এক্স-রে আর অল্প কিছু পরীক্ষা করিয়েই রােগীবান্ধব পদ্ধতিতে এই ধাপ পেরােনাে সম্ভব।
চব্বিশ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ
হৃৎপিণ্ডের নানা সমস্যার ক্ষেত্রে, যেমন বুক ধড়ফড় করা বা অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন থাকলে ১-৩ দিন, এমনকি সপ্তাহব্যাপী হৃৎপিণ্ডের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ বা মনিটর করার প্রয়ােজন হতে পারে।
২৪ ঘণ্টার জন্য রােগীকে ইসিজি লিড (দেখতে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র পাতের মতাে, যা সাধারণ ইসিজির সময় পরানাে হয়) পরিয়ে দেওয়া হয়, সঙ্গে থাকে মুঠোফোনের মতাে ক্ষুদ্র একটি যন্ত্র। একে বলা হয় হল্টার মনিটরিং।
২৪ ঘণ্টা পর সব কটি ‘রিডিং’ পেয়ে যান চিকিৎসক; যা পর্যালােচনা করে হৃৎস্পন্দনের ছন্দে কোনাে সমস্যা থাকলে তা নির্ণয় করা যায়। |
রােগী উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন কি না, তা নির্ণয়ে জটিলতা হলে কিংবা কিছু জটিল ক্ষেত্রে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধের ডােজ ঠিক করার ক্ষেত্রে অ্যাম্বুলেটরি ব্লাড প্রেশার মনিটরিং (এবিপিএম) করার প্রয়ােজন পড়ে।
এতে স্বক্রিয়ভাবে ২৪ ঘন্টা রক্তচাপ মাপা হয় রােগীর। তবে সব রােগীর এসব পরীক্ষা প্রয়ােজন হয় না। প্রাথমিক অবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়লে এবং দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলে হৃৎপিণ্ড, কিডনি ও চোখের মতাে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিরাট ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যায়।
সিটি করােনারি এনজিওগ্রাম
সিটি স্ক্যানে যেমন শরীরের কোনাে অংশের অভ্যন্তরের এক বা একাধিক ছবি দেখা যায়, তেমনি সিটি এনজিওগ্রামে শরীরে কোনাে যন্ত্র প্রবেশ না করিয়েই হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির ছবি দেখা সম্ভব।
এতে রােগীর রক্তনালির বিস্তৃতি এবং সেখানে ব্লকের পরিমাণ বােঝা যায়, ভবিষ্যতে হৃদ্রােগের ঝুঁকিও নির্ণয় করা যায়। হৃৎপিণ্ড থেকে বের হওয়া অন্যতম রক্তনালির (অ্যাওর্টা) রােগও ধরা পড়ে এখানে। এ ছাড়া বাইপাস করা রােগীর বাইপাস গ্রাফটের বিষয়ে জানা যায় এমন পদ্ধতিতে।
Conclusion:
সঠিক সময়ে রােগ নির্ণয় করতে না পারার কারণে আমাদের দেশে আকস্মিক হৃদরােগে মৃত্যুহার অনেক বেশি। রুটিন চেকআপ করেন না অনেকেই, শরীরে যে হৃদরােগের বীজ বহন করে চলেছেন, তা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন বেশির ভাগ রােগী।
অথচ উন্নত বিশ্বের মতাে বাংলাদেশেও ৪০ পেরােনাে প্রত্যেকে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তির হৃৎসমস্যা অগ্রিম নির্ণয় করা গেলে অনেক জীবন রক্ষা করা যেত, অনেকেই দীর্ঘকাল কর্মক্ষম থেকে দেশকে সেবা দিতে পারতেন। হৃদরােগ নির্ণয়ের এসব আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সবাইকে হৃদযন্ত্রের সুস্থতা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে পারে।
হৃদরোগ এবং আধুনিক প্রযুক্তি