প্রায় সব মানুষই জানে গাছেরও প্রাণ আছে এবং এই ধারণাটি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য । আর এই গবেষনা করে ইতিহাসে যিনি অমর হয়ে আছেন তিনি হলেন স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ।
স্যার জগদীশচন্দ্র বসু
স্যার জগদীশচন্দ্র বসু |
পরিচয়
১৯০১ সালের ১০ মে লন্ডনের রয়াল সোসাইটির হলঘর লোকে লোকারণ্য। লোকে সেখানে ভিড় করেছে এক ভারতীয় বিজ্ঞানীর কথা শোনার জন্য আর তাঁর তৈরি এক আশ্চর্য যন্ত্র দেখার জন্য।
সেই বিজ্ঞানী পরীক্ষা করে দেখাবেন যে, প্রাণীর মতো উদ্ভিদেরও চেতনা আছে, বোধ আছে। সেও আমাদের মতো সাড়া দেয়।
সত্যিই সেদিন সেই ভারতীয় বিজ্ঞানী তা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন আর তার জন্য সারা পৃথিবী তাঁকে এক মস্ত বড় বিজ্ঞানী বলে মেনে নিয়েছে।
কে এই বিজ্ঞানী? তিনি হলেন স্যার জগদীশচন্দ্র বসু (Jagadish Chandra Bose)। তিনি ভারতের তথা ভারতবর্ষের এক শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ছিলেন। বলতে গেলে জগদীশচন্দ্রই আমাদের দেশে আধুনিক বিজ্ঞানের চর্চা শুরু করেছিলেন।
স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর জন্ম
জগদীশচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর। তাঁর বাবা ভগবানচন্দ্র ছিলেন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট।
ছাত্রজীবন
জগদীশচন্দ্রের লেখাপড়া ফরিদপুরেই একটা ছোট পাঠশালায় শুরু হয়েছিল। বাবা ভগবানচন্দ্র ইংরেজ আমলের ম্যাজিস্ট্রেট হলে কী হবে, তিনি ছিলেন একেবারে খাঁটি বাঙালি।
বিলেতি চালচলন তাঁর মোটেই পছন্দ ছিল না। ছেলে জগদীশচন্দ্রও বাবার এই স্বভাবটা পেয়েছিলেন।
পাঠশালার পড়া শেষ হলে জগদীশচন্দ্র কলকাতায় এসে প্রথমে হেয়ার স্কুলে এবং তারপরে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হন।
১৮৭৫ সালে তিনি বৃত্তি নিয়ে ম্যাট্রিকুলেশন বা প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন।
১৮৮০ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়ে বি.এ. পাশ করেন। বি.এ. পাশ করার পরে জগদীশচন্দ্র বিলেতে যান ডাক্তারি পড়তে।
ডাক্তারি পড়ার খুব একটা ইচ্ছে তাঁর নিজের ছিল না। বাবার ইচ্ছেতেই ডাক্তারি পড়ার জন্যে লন্ডনের এক মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন।
কিন্তু এসময় তাঁর শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। আর ডাক্তারিতে মনও বসছিল না। তাই পরের বছর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.এসসি. ক্লাসে ভর্তি হন এবং ১৮৮৪ সালে বি.এসসি. পাশ করে দেশে ফিরে আসেন।
কর্মজীবন ও গবেষনা
দেশে ফিরে প্রেসিডেন্সি কলেজে সামান্য বেতনে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
এসময় তিনি একদিকে যেমন খুব নিষ্ঠার সঙ্গে অধ্যাপনা করতে লাগলেন, অন্যদিকে তেমনি এসময় থেকেই তিনি ডুবে রইলেন নানা গবেষণার কাজে।
জগদীশচন্দ্রের প্রথম দিকের গবেষণার বিষয় ছিল তারের সাহায্য ছাড়াই খবর বা সংকেত কীভাবে দূরে পাঠানো যায় তাই নিয়ে।
দিনের পর দিন প্রচুর পরিশ্রম করে তিনি এমন একটা যন্ত্র তৈরি করলেন যাতে তিনি এতদিন ধরে যা চাইছিলেন তা করা সম্ভব হল।
ওই যন্ত্রের সাহায্যে কোনো তার ছাড়াই এক ঘর থেকে দূরের আরেক ঘরে সংকেত পাঠানো সম্ভব হল।
বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ, তারই সাহায্যে জগদীশচন্দ্র এই বিরাট আবিষ্কারটি করেছিলেন। তাঁর এই গবেষণার জন্য তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর অব সায়েন্স উপাধি লাভ করেন।
উদ্ভিদেরও চেতনা আছে
এরপর উদ্ভিদের চেতনা অনুভূতি এসব নিয়ে গবেষণা করতে থাকে জগদীশচন্দ্র। গবেষণা যতই এগোয় ততই তাঁর এই বিশ্বাস হতে থাকে যে প্রাণীদের মতো উদ্ভিদেরও চেতনা বা বোধ আছে।
নানাভাবে স্পর্শ বা আঘাত করলে উদ্ভিদও সাড়া দেয়। এই ব্যাপারটা প্রমাণ করার জন্য তিনি অনেকগুলো যন্ত্র তৈরি করেন। তার মধ্যে ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্রটাই আসল।
এই যন্ত্র দিয়ে তিনি সারা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিলেন যে গাছেরও বোধ আছে, কষ্ট আছে, যন্ত্রণা আছে।
ক্রেসকোগ্রাফ |
ব্রোমাইড নামে একরকম বিষ লাগিয়ে দিলে উদ্ভিদ কীভাবে প্রথমে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল আর তারপর ধীরে ধীরে মরে গেল, তা দেখিয়ে তিনি সবাইকে অবাক করে দেন।
ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্র উদ্ভিদের নড়াচড়া বা কুঁকড়ে যাওয়া অনেক বড় করে দেখায়। উদ্ভিদের এই কুঁকড়ে যাওয়া এমনিতে খালি চোখে দেখা যায় না। তবে লজ্জাবতী পাতার কুঁকড়ে যাওয়া খালি চোখে দেখা যায়।
দেশবিদেশের নানা সম্মান লাভ করেছিলেন জগদীশচন্দ্র। ১৯১৭ সালে তিনি বিজ্ঞান চর্চা আর গবেষণার জন্যে ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ নামে একটি সংস্থা তৈরি করেন কলকাতায়।
আমাদের দেশের গৌরব যাঁরা বাড়িয়েছেন স্যার জগদীশচন্দ্র বসু তাঁদেরই একজন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীকালে বিজ্ঞানী হিসেবে বিখ্যাত হয়েছেন।
জগদীশচন্দ্র শুধু বিজ্ঞান নিয়েই থাকতেন না। সাহিত্যও খুব ভালোবাসতেন তিনি। লিখতেনও প্রায়ই।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু। তাঁর লেখা ‘অব্যক্ত’ নামের বইটিতে তাঁর রচনাশক্তির প্রমাণ পাই আমরা।
১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর গিরিডিতে এই বিখ্যাত বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়।
স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর সংক্ষিপ্ত পরিচয়
জন্ম |
৩০ নভেম্বর ১৮৫৮ বিক্রমপুর, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ, বাংলাদেশ)
|
---|---|
মৃত্যু |
২৩ নভেম্বর ১৯৩৭ (বয়স ৭৮) গিরিডি, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে গিরিডি, ঝাড়খণ্ড, ভারত)
|
বাসস্থান |
কলকাতা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান কলকাতা , ভারত) |
নাগরিকত্ব |
ব্রিটিশ ভারতীয় (জন্মসূত্রে) |
জাতীয়তা |
ব্রিটিশ ভারতীয় |
কর্মক্ষেত্র |
পদার্থবিজ্ঞান, জৈবপদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, বাংলা সাহিত্য, বাংলা কল্পবিজ্ঞান |
প্রতিষ্ঠান |
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় |
প্রাক্তন ছাত্র |
হেয়ার স্কুল সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রাইস্ট কলেজ, কেমব্রিজ, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় |
শিক্ষায়তনিক উপদেষ্টাবৃন্দ |
জন উইলিয়াম স্ট্রাট |
উল্লেখযোগ্য ছাত্রবৃন্দ |
|
পরিচিতির কারণ |
মিলিমিটার তরঙ্গ
|
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার |
সিআইই (১৯০৩) সিএসএই (১৯১১) নাইট ব্যাচেলর (১৯১৭) |
স্ত্রী/স্বামী |
|