মেরি কুরি ও পিয়ের কুরি | বিজ্ঞান সাধনায় শ্রেষ্ঠ যে পরিবার

মেরি কুরিকে কে না চিনে ? মহান পদার্থবিজ্ঞানী, অক্লান্ত গবেষক ও প্রথম মহিলা নোবেল বিজয়ী, মহিয়সী নারী মেরি কুরি । তিনি তার আবিষ্কার এবং দুবার নোবেল পুরষ্কার পেয়ে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন ।


মেরি কুরি | বিজ্ঞান সাধনায় শ্রেষ্ঠ যে পরিবার


মেরি কুরি
মেরি কুরি

মারিয়া

সালটি মনে আছে, তারিখটা মনে নাই। ১৯০৩ সালে গ্রীষ্মের কোনো এক রাতে প্যারিসে এক বন্ধুর বাড়িতে জড়ো রাতের খাবারের নিমন্ত্রণ হয়েছিলেন কয়েকজন।

বন্ধুরা জমায়েত হয়ে ভাবলেন, সন্ধ্যায় বন্ধুটির বাগানে যাওয়া যাক বাতাস খাওয়ার জন্য । ডিনারের দাওয়াতের উপলক্ষ কি ছিল?

এদের এক বন্ধু হলেন পদার্থ বিজ্ঞানী মেরি কুরি। সেদিন তিনি বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন। একে উদযাপনের জন্যই এই রাতের খাবারের নিমন্ত্রণ। 

পাঁচ বছর আগে তিনি ও তাঁর স্বামী দু’জনে মিলে আবিষ্কার করেছিলেন দুটো নতুন মৌলিক পদার্থ রেডিয়াম পলোনিয়াম

এই আবিষ্কারের জন্য তাঁরা দু’জনে মিলে পেয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ। সেদিনের নৈশভোজে তাঁরা এসেছিলেন এই পদার্থ দুটো দেখাবার জন্য।

বন্ধুরা সব যখন বাগানে বসলেন মেরি কুরির স্বামী বিজ্ঞানী পিয়েরে কুরি বের করলেন, আলোতে ঝলমল তরল পূর্ণ একটি নল।

নলের ভেতর ছিল খুব শক্তিশালী রেডিয়াম দ্রবণ, আর ছিল জিংক সালফাইডের আস্তর। রেডিয়াম একে দিচ্ছিল উজ্জ্বল রঙিন আভা।

এই প্রতিপ্রভাকে চমৎকার উজ্জ্বল দেখাচ্ছিলো অন্ধকারে। সেই রাতের কথা স্মরণ করে ব্রিটিশ পদার্থ বিজ্ঞানী লর্ড রাদারফোর্ড বললেন, ‘অন্ধকারে আলোকছটা হয়ে উঠেছিল আরো অনেক উজ্জ্বল। আর সেদিন ছিল একটি অবিস্মরণীয় দিনের দীপ্তিময় অবসান। 

এমন কথা কেন বলেছিলেন লর্ড রাদারফোর্ড?

সে রাতে রাদারফোর্ড লক্ষ্য করলেন পিয়েরে কুরির হাত দুটোতে একটি অমঙ্গল চিহ্ন। রেডিয়াম রশ্মির প্রভাবে ক্ষত প্রদাহ আক্রমণ করেছে হাত দুটোকে ব্যথাও রয়েছে সে হাতে । 

অথচ পিয়েরে কুরি কত কষ্টে যন্ত্রণা সহ্য করছেন । রেডিয়ামের বিকিরণে আহত হয়ে এভাবে পিয়েরে কুরির জীবনাবসন হলো কিছুদিনের মধ্যেই।

পিয়েরে কুরি এবং স্ত্রী মেরি কুরি দু’জনে মিলে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণা করে আবিষ্কার করেছিলেন দুটো মৌলিক উপাদান পলোনিয়াম রেডিয়াম। 

পদার্থ দুটো থেকেই অনেক তেজ বেরুতো, মেরি এজন্য এদের বল্লেন, তেজস্ক্রিয়। নামটি তাঁরই দেয়া।

এখানে থামি। এবার একটু গোড়ার কথায় আসি।

রেডিয়ামের কথা বলি। বিশুদ্ধ রেডিয়াম বলে তেমন কিছু নেই, জানো। পদার্থটি পৃথক করলেও অবিলম্বে যৌগ হয়ে যায়। সোডিয়ামের সঙ্গে রেডিয়ামের একটি মিল আছে।

সোডিয়ামের মতই পৃথক করলেই রেডিয়ামের ভয়ানক আসক্তি হয় অক্সিজেনের সঙ্গে মিলবার। তাই পৃথক হলেই বাতাসে জারণ ঘটে এর। রেডিয়াম মানে রেডিয়াম ক্লোরাইড। 

সাধারণ লবণের দানার মতো দেখতে, গুড়ো করলে মিহি পাউডারের মতো হয়, কিন্তু এটি এত শক্তিশালী ও ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী যে একে সীসার মোড়কে কাচের নলে রাখতে হয়। 

রেডিয়াম থেকে তেজ বেরোয়, তাই রেডিয়াম থেকে যে রশ্মি বেরোয় সেগুলোকে সীসা ঠেকাতে পারে, কিন্তু কাচ তা পারে না।

রেডিয়াম যে কত শক্তি ধরে তা একটা ঘটনা পড়ে জানবেন। 

  • রেডিয়াম থেকে বিজ্ঞানী বেকেরেলের হাত জ্বলা ও পরে দগ্ধ হওয়ার ঘটনা। 
  • এন্টনি হেনরি বেকেরেল ছিলেন একজন ফরাসি পদার্থ বিজ্ঞানী। প্রতিপ্ৰভা বিষয়ে তিনি ছিলেন বিশেষজ্ঞ। 


বিজ্ঞানী বেকেরেল ও তেজস্ক্রিয়তা 

তেজস্ক্রিয়তা আসলে প্রথমে আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী বেকেরেল। এবার ঘটনাটি বলি । 

পিচব্লেন্ড নামে একটি কৃষ্ণ কালো খনিজ থেকে অল্প হলেও রেডিয়াম লবণ বের করেছিলেন মেরি কুরি, এর কিছুকাল পর লন্ডনে এসেছিলেন হেনরি বেকেরেল

হেনরি বেকেরেল কি করলেন ? নতুন খুঁজে পাওয়া একটি পদার্থের সামান্য পরিমাণ, আলপিনের মাথার চেয়ে একটু বড়ো, তেমন আয়তনের, খুব ছোট একটু রেডিয়াম নিলেন । 

ছোট কাচের নলে রেখে, রেখে দিতেন ওয়েস্টকোটের পকেটে। তাঁর কাছে এটি এত মূল্যবান ছিল যে সবসময় কাচের নলটি কোটের পকেটে রাখতেন।

যা হবার তা হলো।

দশদিনের মধ্যে তিনি বুঝলেন, রেডিয়াম নলটি শরীরের যেখানে চেপে বসেছিল, সেখানে একটু ক্ষত হয়ে গেল। আসলে তিনি দেখলেন জায়গাটি পুড়ে গেছে। 


ক্যান্সার চিকিৎসায় তেজস্ক্রিয়তা 

রেডিয়াম থেকে যে রশ্মি বেরিয়েছিল সেটি তার মাংসপেশীর কিছু কোষ দগ্ধ করেছে। অনেক ভালো চিকিৎসার পরও গভীর এই ক্ষতটি শুকাতে এবং ব্যথা সারতে কয়েক হপ্তা লাগলো।

তবে ডাক্তাররা ক্রমেই বুঝতে পারলেন যে এই রশ্মিগুলোর ধ্বংস করার ক্ষমতা এতো বেশি হলেও রোগের চিকিৎসায়ও এর ব্যবহার সম্ভব। 

আব বা আঁচিল চিকিৎসায় প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল রেডিয়াম। আঁচিলকে অনেক সময় আমরা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করি, কিন্তু অনেক সময় এটি বড় সমস্যা ঘটাতে পারে। 

পায়ের তলে আব হলে ল্যাংড়া হতে হয় বিলক্ষণ। চোখের পাতায় আচিল হয়ে দৃষ্টিতে পড়ে বাধা। জিবেও আঁচিল হতে পারে, এমনকি আঙুলের নখের নিচেও।

সার্জন হয়তো আচিল কেটে ফেললেন, তবে প্রায় তা আবার ফিরে আসে। অন্য উপায় কী? ডাঃ এবে করলেন কি, মেরি কুরির কাছ থেকে আড়াই গ্রেন রেডিয়াম নিয়ে এবং সেই রেডিয়াম আচিলের উপর ৩০ মিনিট প্রয়োগ করার পর দেখলেন, আঁচিল মিলিয়ে গেলো। 

এমনকি ক্ষতের কোনো চিহ্নও থাকলো না। ডাক্তাররা যখন দেখলেন, আঁচিল সরাতে সক্ষম হচ্ছে রেডিয়াম, তখন আরও বিপজ্জনক টিউমারের উপর এর প্রয়োগ দেখতে চাইলেন। 

সবচেয়ে ভয়ানক রোগ ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করার বড় হাতিয়ার হয়ে উঠলো রেডিয়াম। এই রেডিয়াম আবিষ্কার করেন মেরি কুরি। 

তিনি এজন্য পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পেলেও চিকিৎসায় এর ব্যবহার হলো বেশি করে। সত্যি করে বলতে গেলে ক্যান্সার চিকিৎসায় রেডিয়াম হয়ে উঠলো অপরিহার্য। 


আলফা, বিটা গামা

সেসব পুরনো দিনে অনেক অনেক আবিষ্কার হয়েছিল।

রেডিয়াম থেকে তিন ধরনের রশ্মি বের হয়— 

  1. আলফা, 
  2. বিটা ও 
  3. গামা রশ্মি। 

লর্ড রাদারফোর্ড পরমাণু বিভাজনের জন্য ব্যবহার করেছিলেন আলফা রশ্মি। যে রশ্মিতে হেনরি বেকেরেলের হাত পুড়েছিল তা ছিল আলফা রশ্মি। বিটা রশ্মির কাজ অন্যরকম। উদ্ভিদের বাড়নে বেশ সহায়তা করে।

সবচেয়ে আশ্চর্য রশ্মি হলো গামা রশ্মি। আলোর গতিতে এ রশ্মি চলে, ভেদ করার ক্ষমতা খুব বেশি। 

  1. একটি কাগজের শিট আলফা রশ্মিকে ঠেকাতে পারে, 
  2. একটি টিনের পাত ঠেকাতে পারে বিটা রশ্মি আর 
  3. গামা রশ্মি ভেদ করতে পারে আধ ইঞ্চি পুরু ইস্পাতকে ।

ক্যান্সারের উপর ভালো কাজ করে এই গামা রশ্মি।


পিয়েরে কুরি

রেডিয়াম এর কথা বলতে গিয়ে প্রথমে স্মরণ করতে হয়, পিয়েরে কুরিকে। একজন ডাক্তারের ছেলে পিয়েরের জন্ম ১৮৫৯ সালে।

পিয়েরের বাবা ছিলেন একজন উদার মনের মানুষ। ছেলের উপর কোনো কিছু চাপিয়ে না দিয়ে তিনি তাকে নিজের মতো করে ভাবতে দিলেন। 

শেখালেন কী করে প্রকৃতিকে ভালবাসতে হয়, জানতে হয়, শিখতে হয় অনেক কিছু চারপাশের পরিবেশ থেকে। পিয়েরে এবং তার ভাই জেকুয়েস দুজনে খুব আনন্দ-ফুর্তিতে বড় হতে লাগল।

জেকুয়েস ছিল খুব চটপটে আর পিয়েরে ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির। অংকে বেশ দক্ষ ছিলেন পিয়েরে। 

এমন কথা বলি আমরা যে, গণিতে ভালো না হলে ভালো বিজ্ঞানী হওয়া কঠিন। ছুটিতে, অবকাশে পিয়েরে দেশে নানা স্থান ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন । 

কখনও অর্ধেক রাত হয়তো কাটাতেন বনে-জঙ্গলে, গাছ-পালা ফুলের মিষ্টি গন্ধ নিতে নিতে সময় কাটতো তার। বয়স যখন ঊনিশ, পিয়েরে পদার্থবিদ্যায় ডিগ্রি অর্জন করলেন। 

সরবোর্নে যোগ দিলেন বৈজ্ঞানিক সহকারী হিসেবে। তড়িৎ ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। পিয়েরে ও জেকুয়েস দুজনে তড়িৎ নিয়ে কিছু কাজও করলেন। 

চার বছর পর পিয়েরে প্যারিসে ফলিত পদার্থবিদ্যার স্কুলে ল্যাবরেটরি প্রধান নিযুক্ত হলেন। শিক্ষক হিসেবে তার খুব নাম-ডাক, ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে খুব জনপ্রিয়। এভাবে সুখে, আনন্দে বাস্তবজীবন কাটালেন তেরটি বছর।

এরপর তার জীবনে এলো একটি বড় পরিবর্তন… তাঁর এক ছাত্রীর প্রেমে পড়লেন তিনি। মেরি সালোমেয়া স্কলোডোস্কা কুরি। যিনি পরে মেরি কুরি নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। 

এবার মেরি কুরির জীবন, তাঁর আবিষ্কারের কাহিনী বলি। 


মেরি কুরি জীবনী

পোল্যান্ডের ওয়ারশোতে ১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর এক শিক্ষক পরিবারে তাঁর জন্ম। এক ভাই, চার বোন। 

মা-বাবার পঞ্চম ও কনিষ্ঠ কন্যা তিনি। বাবা ছিলেন পিয়ানোবাদক, গায়ক ও শিক্ষক। মা ছিলেন পদার্থবিদ্যা ও গণিতের অধ্যাপক। 


শিক্ষা জীবন

ম্যারিয়ার বয়স যখন এগারো, তখন তাঁর বিদুষী মা যক্ষ্মা রোগে মারা যান। চার বছর বয়স থেকেই ম্যারিয়া লিখতেও পড়তে শিখলেন। 

তাঁর বড় বোন ব্রোনিয়া তাকে হাতে খড়ি দিলেন, শেখালেন বর্ণমালা। পরে বড় বোন থেকেও মেধাবী হলেন ম্যারিয়া। 

শৈশবে তাঁর স্মরণশক্তি দেখে অবাক হয়ে যেতো সবাই। বাবা ছিলেন বিজ্ঞানের শিক্ষক। কিন্তু যে ল্যাবরেটরিতে তিনি কাজ করতেন এতে যন্ত্রপাতি তেমন ছিল না। কলেজের যারা হর্তাকর্তা তারা সেসব দিনে বিজ্ঞান নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন না।

ম্যারিয়ার পরিবার তেমন স্বচ্ছল না তবু তাঁর বাবা নিজের পকেটের টাকা খরচ করে ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি কিনতেন। সংসার চালানোও অনেক সময় কঠিন হতো। 

মাঝে মধ্যে বিলের টাকা পরিশোধের জন্য বাড়ির দু’তিনখানা ঘর ভাড়া দিতে হতো ছাত্র-ছাত্রীদের। 

এমন এক সময় হলো যখন তাঁদের বাড়িতে দশজন ছাত্র বাস করলো তাঁদের সঙ্গে। আর ম্যারিয়াকে সেসময় ডাইনিং ঘরের একটি সোফায় রাতে শুতে হতো।

তাঁর বাবা যে ল্যাবরেটরিতে তাঁর একজন সহকারী নেবেন এরও অর্থ বরাদ্দ ছিল না। তাই মেরি কুরিকে তাঁর বাবা বললেন ল্যাবরেটরিতে এসে কাচের নল ধুয়ে দেওয়া ও গোছগাছ করার জন্য। 

মেরি কুরি সানন্দে রাজি হলো। দিনের অনেক সময় তাঁর কাটে ল্যাবরেটরিতে। শিশু বয়স থেকেই ম্যারিয়া বেড়ে উঠলেন ল্যাবরেটরিতে। 

যে কাচের পাত্রে তাঁর বাবা রাখতেন যন্ত্রপাতি, মেরি কুরি মুগ্ধ চোখে দেখতেন যন্ত্রগুলো। বাবার কাজগুলোর প্রতি আকর্ষণ তাঁর বাড়তে লাগলো। 

দিনে স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে বিকেলে আসতেন ল্যাবরেটরিতে বাবাকে সাহায্য করার জন্য। এদিকে মা যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন। 

ম্যারিয়ার বয়স যখন ১১ তখন তাঁর মার মৃত্যু হলো। বরাবরই ভালো ছাত্রী ছিলেন মেরি কুরি। হাই স্কুল উত্তীর্ণ হবার সময় এত ভালো ফল হলো তাঁর যে তিনি পেলেন স্বর্ণপদক। 

বাবা ঠিক জানতেন, মেয়ে খুব পরিশ্রম করেছে, তাই ভালো ফল হয়েছে। তাই পুরষ্কার হিসেবে পুরো এক বছর তাঁকে গ্রামের বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে কাটাবার অনুমতি দিলেন। 

মামাতো-চাচাতো ভাইবোনদের সঙ্গে চমৎকার কাটলো তাঁর সে সময়। পড়াশোনার প্রবল ইচ্ছে ছিল তাঁর সবসময়। 

ওয়ারশোতে এসে আবার পড়াশোনা শুরু করতে তিনি চাইলেন। কিন্তু কলেজে পড়ার মতো অর্থ কই? সংসারে আয় না হলে সংসারে পড়াশোনা চলে কি করে? 

তাই এবার ম্যারিয়া ও তাঁর বড় বোন ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়াতে শুরু করলেন। কিন্তু পরে মেরি কুরি অনেক ভেবে বড় বোনকে বললেন, ‘আমি আয় করি, তুই বরং লেখাপড়া কর । পরে তুই যখন ডাক্তার হবি, তখন আমাকে পড়ার খরচ তুই দিবি।

বড় বোন রাজি হল। পরিবারে অর্থ কষ্ট আরো বাড়লো। নুন আনতে পানতা ফুরায়—এমন অবস্থা প্রায়। মেরি কুরির বয়স তখন আঠারো। দেশের বাড়িতে এক পরিবারে গভর্নেসের চাকরি নিলেন তিনি। 

যে টাকা পান সেই টাকাতে প্যারিসে বড় বোনের পড়ার খরচ চলে। ছোটবেলায় বাবার ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষানলগুলো ধোয়ার সময় বড় বিজ্ঞানী হবার যে স্বপ্ন দেখতেন তা-কি স্বপ্নই রয়ে যাবে। 

এদিকে চাকরির সুবাদে কৃষকদের বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়েকে পড়াবার সুযোগও পেলেন।

মেরি কুরি প্রেমে পড়লেন মালিকের ছেলের সঙ্গে। কিন্তু ছেলের মা-বাবা রাজি হলো না। তাদের ছেলেকে বিয়ে করার মতো অর্থশালী তো নয় ম্যারিয়া। 

এদিকে রাশিয়ান প্রভুদের নির্যাতনে ওয়ারশোর জনগণ বিপর্যস্ত, এভাবে একদিন পোল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু হলো।

বিদ্রোহীদের একজন ছিলেন ম্যারিয়া, কিন্তু সংগ্রাম ব্যর্থ হলো, মেরি কুরিকে ঘর থেকে বের করে দেয়া হলো।

তিনি পালিয়ে বাঁচলেন প্যারিসে। তখন বয়স তাঁর মাত্র বাইশ বছর। একা, বন্ধুবান্ধব নেই, হাতে টাকা-পয়সা নেই। অনাহার থেকে জীবন রক্ষার জন্য কেবল মগজের বুদ্ধি এবং শ্রম দেবার ইচ্ছাটাই সম্বল। 

ম্যারিয়া নাম বদলে তিনি হলেন মেরি। ঠাণ্ডা একটি ঘরে তিনি জায়গা করে নিলেন। কেবল দুধ, রুটি খেয়ে জীবন বাঁচে। 

কিছুদিন পর তাঁর একটি কাজ জুটলো সোরবোনে। কাজের মধ্যে কাচের বোতল ধোয়া এবং রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য চুলোগুলো সাফসুতরো করে তৈরি করা। 

কিন্তু এই কাজটি মেরি এত ভালো করে করতেন এবং তাঁর জ্ঞানবুদ্ধির এতো ভালো পরিচয় পাওয়া গেলো যে বিভাগের দু’জন নামকরা লোকের নজরে পড়ে গেলেন তিনি। 

একজন হলেন বিভাগের প্রধান গেব্রিয়েল লিপম্যান আর অন্য এক বিজ্ঞানী হলেন হেনরি পয়েনকেয়ার

দু’জনে মিলে আবিষ্কার কররেন মেরির প্রতিভা। আর সঙ্গে সঙ্গে চিঠি লিখলেন তার বাবার কাছে। 

এরপর একটি আনন্দের ব্যাপার ঘটলো। খুব শান্ত, ভদ্র, অথচ চতুর বিজ্ঞানী পিয়েরে কুরির অধীনে তাঁর শিক্ষা শুরু হলো। 

অপূর্ব সুন্দরী মেরি। খুব সুন্দর চুল আর নীল ও ধূসরের মিশেল চোখ দুটো। শান্ত, নম্র অথচ দৃঢ়চেতা মেরি। 

স্নিগ্ধ রূপ তাঁর, কিন্তু কাছে যাওয়া কঠিন। তাকে ঘিরে সে দেয়াল ভেদ করা সবার কাজ নয়। গলার মিষ্টি-স্বর চমৎকৃত করে সবাইকে। পিয়েরে কুরি লম্বা, একহারা শরীর, কিন্তু একটু মুখ ভরা হাসি। হাসিতে রাজ্যের উজ্জ্বলতা। কুঁজো হয়ে হাঁটেন। 

দু’জনে গরিব হলেও কাজের প্রতি দুজনেরই গভীর অনুরাগ। মেরির গ্রাজুয়েশন শেষ হয়েছে। ক্লাসে শীর্ষ স্থান। পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স ডিগ্রিও হলো। এপরপর বৃত্তি পেলেন। গণিতেও হলো মাস্টার্স। 

পরের বছর পদার্থবিদ্যায় পেলেন ডক্টরেট। মেরি ও পিয়েরে একে অপরের প্রেমে পড়লেন। কাজ করতে করতেই বুঝলেন একজন ছাড়া অন্যজনের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। দুজনে দুজনার। 

পিয়েরে ও মেরির দেখা হওয়াটা তাঁদের নিজেদের ভাগ্য যেমন বদলে দিয়েছিল তেমনি বিজ্ঞানের গতিপথও বদলে গেলো।

মেরি বলেছিলেন, ‘সৌম্য, শান্ত অথচ গম্ভীর চেহারার একজন মানুষ। আমি দেখেছিলাম এক স্বাপ্নিক পুরুষের ছবি।” ল্যাবে দুজনের কাজ শুরু হলো। 

দু’জন দু’জনকে শ্রদ্ধা করেন, এরপর ভালো লাগা, ভালোবাসা।

১৮৯৪ সালে গ্রীষ্মে গণিতের পরীক্ষায় সাফল্যের পর পোল্যান্ডে ফিরে এলেন তিনি ছুটিতে, ফ্রান্সে ফিরে যেতে পারবেন কি-না এ নিয়ে মনে দ্বন্দ্ব দোলা।

পিয়েরের চিঠি তাকে প্যারিসে ডক্টরেট করার প্রেরণা দিল। মেরি বললেন, ‘আমাদের কাজ আমাদেরকে কাছে টেনে নিয়ে এল। একসময় আমরা দুজনে বুঝলাম আমরা দুজনেই এরচেয়ে ভালো সাথী পাবো না ।”


নতুন সংসার

জুলাই ১৮৯৫। সাধারণ ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তাঁদের বিয়ে হলো। আংটি বদলও হলো না। তেমন নিয়ম পালনও হলো না। দুজন দুজনকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে মেনে নিলেন।

চাচাতো এক বোন বিয়েতে উপহার হিসেবে যে অর্থ দিলেন তা দিয়ে তাঁরা দুটো বাইসাইকেল কিনলেন, একটি মেরির জন্য অন্যটি পিয়েরের জন্য। 

সে সাইকেলে চড়ে তাঁরা গেলেন ফ্রান্সের শহরতলীতে মধুচন্দ্রিমায়। 

পিয়েরের বয়স তখন ছত্রিশ এবং মেরির আটাশ। ঘরে পরিচারিকা রাখার সামর্থ্য নেই। ছোট্ট নীড় বাঁধলেন তাঁরা। 

ঘর ঝাট দিয়ে সাফসুতরো করেন পিয়েরে আর মেরি করেন সহজ সরল রান্না। হাট-বাজারে বেশি খরচ করার মতো অর্থকড়ি নেই। কিন্তু খুব সুখী দম্পতি তাঁরা। 

ঘর থেকে খুব একটা বেরোন না তাঁরা, সন্ধ্যায় দুজনে বসে নীরবে কাটান, মাঝে মধ্যে বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে আলোচনা চলে ।

১৮৯৫ সাল, যে সালে তাদের বিয়ে হলো, সেই বৎসর দুটো উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হলো। বিজ্ঞানী রঞ্জেন আবিষ্কার করলেন এক্স-রে। 

সেই অদৃশ্য, রহস্যময় রশ্মি ভেদ করতে পারে মাংস, হাড়, এরকম অনেক কিছু, কালো কাগজে এর ছবি হয়- আশ্চর্য!


এর একবছর পর কুরি দম্পতির সহকর্মী বেকেরেল আবিষ্কার করলেন ইউরেনিয়াম থেকে বেরিয়ে আসা তেজস্ক্রিয়তা। এক্স-রে মতো এই রশ্মিও ভেদ করতে পারে- অস্বচ্ছ পদার্থ।

আরও বলি। জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী উইলিয়াম জে শ্ম আবিষ্কার করে। এর নাম দিলেন এক্স-রে, এক্স মানে ‘অজানা’। এই আবিষ্কারের জন্য ১৯০১ সালে উইলিয়াম রনজেন পেলেন পদার্থবিদ্যায় প্রথম নোবেল।


তেজস্ক্রীয় পদার্থ পলোনিয়াম আবিষ্কার

কুরি দম্পতি এ দুটো আবিষ্কারে বেশ প্রভাবিত হলেন। শুরু হলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা। মাদাম কুরি নতুন সব মৌলিক পদার্থ পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। 

ইউরেনিয়াম ছাড়া অন্য কোনো পদার্থের এ ধরনের অসাধারণ রশ্মি বের করার শক্তি আছে কিনা, তাই দেখতে চেয়েছিলেন তিনি।

ইলেকট্রোস্কোপ নামে ছোট্ট একটি যন্ত্র ব্যবহার করেন, সোনার পাতের টুকরো দিয়ে বাঁধা সে যন্ত্র। 

পিচ ব্লেন্ড নামে একটি কৃষ্ণধাতু নিয়ে তারা পরীক্ষা শুরু করলেন, এই ধাতু থেকে ইউরেনিয়াম নিষ্কাশন করা হয়েছিল। 

মাদাম তুরি অবাক হয়ে দেখলেন এ থেকে বের হওয়া তেজস্ক্রিয়তা আশাতীত। যা ভাবা হয়েছিল এর চেয়ে চারগুণ বেশি।

তেজস্ক্রিয়তা হলো কোনো কোনো মৌলিক পদার্থ যেমন ইউরেনিয়াম পরমাণু বিভাজনের ফলে এনার্জি ও তেজস্ক্রিয় কণার বিচ্ছুরণ।

কুরি দম্পতি বুঝতে পারলেন কৃষ্ণকলি এই ধাতুর মধ্যে আর কোনো অজানা তেজস্ক্রিয় পদার্থ আছে যা ইউরেনিয়াম থেকেও শক্তিশালী। একে খুঁজে বের করা যায় কীভাবে?

তারপর প্রশ্ন হলো, এই কাজের জন্য যথেষ্ট পিচ ব্রেড কীভাবে পাওয়া যাবে? একে কেনার মতো অর্থ তাদের কাছে নেই। 

ভাগ্য ভালো। অস্ট্রিয়ার সরকার বোঘেমিয়াতে নিজস্ব মাইন থেকে তুলে একটন পিচ ব্লেন্ড পাঠালেন তাদের। মূল্যবান উপহার তো বটেই। একটনের দাম দুহাজার পাউন্ডেরও বেশি।

এরপর কাজ শুরু হলো। কঠিন পাথর ছোট করে করে, অজানা সেই পদার্থকে সন্ধান করা…।

জটিল এক রাসায়নিক পদ্ধতি অনুসরণ করে, এর খোঁজ চলল। কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে যায় কুরি দম্পতির পরীক্ষা আর শেষ হয় না। 

ধাতুকে প্রথম সিদ্ধ করা, এরপর পরিশ্রুত করা, তলানি রেখে উপরের তরলটি ফেলে দেওয়া, এরপর স্ফটিকে রূপান্তরিত করা। 

বারবার এ পদ্ধতি অনুসরণ করে খোজ চলল। শেষে খুব শক্তিশালী একটি তেজস্ক্রিয় পদার্থ পাওয়া গেল।

মেরি কুরি, নিজের জন্মভূমির নাম অনুসরণ করে এর নাম দিলেন ‘পলোনিয়াম‘ কিন্তু অনুসন্ধানের শেষ সেখানে হলো না। খোঁজ চলল, চলল…

অবশেষে ১৯০২ সালে তাঁরা রেডিয়াম সল্ট সনাক্ত করতে সক্ষম হলেন। নুনের ছোট চামচের অর্ধেক ভরে সে পরিমাণ রেডিয়াম।

সে কাজ শেষ হতে চার বছর লাগল। কাজটি কেবল কঠিনই ছিল না, বিপজ্জনকও ছিল। রেডিয়াম টিউবগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে পিয়ের কুরির হাত দুটোর অবস্থা হয়েছিল শোচনীয়। 

তখনকার দিনে এত দ্রুত গতিতে বিচ্ছুরিত রশ্মির বিপদ যে কত ভয়ানক হতে পারে, কেউ তা ভাবেনি।

১৯০৩ সালে প্যারিস সায়েন্স ফ্যাকালটির সামনে গবেষণা প্রবন্ধ পাঠ করলেন মেরি, এবং এতেই তিনি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠলেন। পেলেন ডক্টরেট ডিগ্রি। 

পত্রিকার রিপোর্টার ও আলোকচিত্রীরা তাঁকে ঘিরে ধরে সফলতার কারণ, তাঁর জীবন, এসব নিয়ে জানতে চাইল। 

মেরি কুরি যথারীতি নম্র ও মৃদুভাষী। তাদের অনেক কথা তিনি এড়িয়ে গেলেন। এরপর কুরি দম্পতির জয়জয়কার। 

লর্ড কেলভিনের আমন্ত্রণে এলো, তাদের দেয়া হলো রয়েল সোসাইটির ‘ডেভি স্বর্ণপদক’। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি শ্রেষ্ঠ সম্মান।

একই বছর তাঁদের জন্য এলো আরো একটি পুরস্কার।

পিয়েরে ও মেরি কুরি বিজ্ঞানী হেনরি বেকরিলের সঙ্গে পেলেন পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার। তাঁদের কাজের জন্য ও তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের জন্য এ পদক দেয়া হলো।

ছয় হাজার পাউন্ড পরিমাণ অর্থ তাঁরা পেলেন, এর মধ্য থেকে সামান্য কিছু অর্থ নিজেরা নিয়ে বাকি অর্থ দিলেন বন্ধু ও পরিবারের অন্যদের সাহায্য হিসাবে।

রয়েল ইনস্টিটিউশনে রেডিয়াম নিয়ে বক্তৃতা বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করল। ঘা ও ফোসকা পড়ে কুরির হাত ক্ষত-বিক্ষত, নিজের ক্ষতকে নিজে ড্রেস করা সম্ভব হচ্ছিল না, তবু যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে হলো, বক্তৃতাও দিতে হল।

রেডিয়াম যে অবিরাম তাপ ছড়ায় একে প্রমাণ করার জন্য পিয়েরে নিলেন কাচের দুটো পাত্র, একটিতে ছিল থার্মোমিটার ও রেডিয়াম টিউব, অন্যটিতে ছিল শুধু থার্মোমিটার, তবে রেডিয়াম নয়। 

আগের পাত্রে যে তাপমাত্রা তা অন্যটির চেয়ে সবসময় ৫.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেশি ছিল । এও দেখালেন পিয়েরে—জিংক সালফাইডের হলুদ চূর্ণ রেডিয়াম রশ্মিতে উজ্জ্বল আলোকে আলোকিত হয়ে উঠছিল।

আরও দেখানো হলো, রেডিয়াম রশ্মির প্রভাবে অনেক পদার্থই তেজস্ক্রিয়তার গুণ পেতে পারে। 


নতুন চাকরিতে যোগদান

আর একটি কথা জানেন? আসল হীরক ও নকল হীরক চেনার সহজ উপায় হলো রেডিয়াম ব্যবহার। 

আসল হীরাকে রেডিয়াম খুব উজ্জ্বল আলোতে আলোকিত করে তুলে আর নকল হীরার ক্ষেত্রে তেমন কিছুই হয় না। এসব নতুন আবিষ্কারগুলোর জন্য সোরবোন-এ ভালো চাকরি পেলেন কুরি দম্পত্তি।

জীবনে এই প্রথম এই দুই পরিশ্রমী প্রতিভাধর ব্যক্তি স্বচ্ছলতার স্পর্শ পেলেন, পেলেন আরাম, স্বস্তি।

সোৱবোনে অধ্যাপকের পদে পিয়েরে আর তেমনি এক উচ্চপদে বসলেন মেরি কুরি। ইতোমধ্যে তাদের ঘর আলো করে একটি কন্যা সন্তান এসেছিল। 

জীবনে এবার এল কিছুটা সুখ ও প্রচণ্ড ব্যস্ততা। কিন্তু এ সুখ যে তাঁদের বেশি দিন সইবে না, তা কি তাঁরা জানতেন? এরপর এলো একটি বড় বিপর্যয়ের দিন। 


পিয়ের কুরির মৃত্যু

১৯০৬ সালে তেমনি একটি দিন। পিয়েরে কুরি ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজন করতে বেরিয়েছেন। 

খুব খুশি, উৎফুল্ল ছিলেন পিয়েরে কুরি, মধ্যাহ্ন ভোজে বসে বন্ধুদের বলছিলেন “শোনো সবাই। এবার ছাত্র পড়ানো ছেড়ে দেবো। কেবল গবেষণা করা হবে আমার কাজ “ 

তাই বলে আনমনে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। বন্ধুদের ছেড়ে, পায়ে হেঁটে রওনা দিলেন বাড়ির দিকে। বন্ধুরা সব অবাক। 

হন হন করে বেরিয়ে গেলেন পিয়েরে কাউকে কিছু না বলে। রাস্তায় অনেক ভিড়। যানবাহনের জট। লোকজনের ও জটলা। আনমনে রাস্তা পেরোতে গেলেন, জোরে ছুটে আসা একটি ঘোড়ার গাড়ির তলায় চাপা পড়লেন পিয়েরে। সেখানেই মৃত্যু হলো তাঁর ।

পিয়েরের মৃত্যুতে খুব মুষড়ে পড়লেন মেরি কুরি। পিয়েরে ছাড়া জীবন যে তিনি কল্পনাও করতে পারেন না। 

এতদিন যেখানে গেছেন এক সাথে গেছেন, এক সাথে কাজ করেছেন, সুখে-দুঃখে পাশে থেকেই তো তাঁদের জীবন কাটছিল। কিন্তু বিধি বাধ সাধলেন।

তবু মেরি ছিলেন সাহসী মহিলা, মনের জোর ছিল তাঁর খুব বেশি। সেই মনের জোরেই তিনি কাটিয়ে উঠলেন স্বামী হারানোর শোক। 

একদিন ফিরে এলেন ! ল্যাবরেটরিতে ফিরে এলেন কাজে। সোৱবোনে ক্লাসও নিতে শুরু করলেন। পিয়েরের ক্লাসগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম মহিলা শিক্ষক মেরি কুরি।

তাঁর বন্ধুদের মেরি বললেন, যতদিন তিনি জীবিত থাকবেন ততদিন পিয়েরেও তিনি একত্রে যে গবেষণা শুরু করেছিলেন, তা চালিয়ে যাবেন। 

তিনি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। মেয়ে দুটোকে লালন পালন করা নিয়ে তিনি ভাবছিলেন। পিয়েরের বাবা ডা. কুরি মেরির পরিবারে থেকে মেয়ে দুটোকে দেখাশুনা করতে লাগলেন।চার বছর পর তিনিও মারা গেলেন।

মেরি কুরি
মেরি কুরি


মেরি কুরি ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ

আকস্মিক দুটো মৃত্যুর পরও তিনি ভেঙে পড়লেন না। বড় করে তুলতে লাগলেন দুই মেয়েকেই। 

এদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো। মেরি ভাবলেন যুদ্ধক্ষেত্রে চলমান হাসপাতালে যদি এক্স-রে মেশিন দেয়া যায় তাহলে যুদ্ধে আহত সেনাদের অনেক উপকার হবে।

সৈন্যদের শরীরে কোথায় বুলেট রয়েছে বা বিস্ফোরিত বোমার মাইন বা শেল থেকে ছুটে আসা ধারালো টুকরো কোথায় রয়েছে তা এক্স-রে করে দেখে নিলে চিকিৎসা অনেক সহজ হবে। 

মেরির মেয়ে আইরিনের বয়স তখন ১৭। তিনি নার্স হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে মা’র সঙ্গে কাজ করতে গেলেন।

মেরির এই কাজের জন্য সম্ভবতঃ প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত মহিলা হয়ে উঠেছিলেন। 


রেডিয়াম আবিষ্কার

পিয়েরের মৃত্যুর পর মেরি অঙ্গীকার করেছিলেন গবেষণা চালিয়েই যাবেন। আগে একটা কথা বলেছিলাম। 

১৯১০ সালে তিনি রেডিয়াম পৃথকীকরণ করেন— অর্থাৎ বিশুদ্ধরূপে একে পেলেন এবং এর পারমাণবিক ওজনও বের করলেন।

তেজস্ক্রিয়তার উপর একটি চমৎকার নিবন্ধ তিনি প্রকাশ করলেন এবং ১৯১১ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো পেলেন নোবেল প্রাইজ। 


সুইডিশ রয়েল একাডেমীর সদস্যপদ অর্জন

পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম এই দুটো তেজস্ক্রিয় পদার্থ আবিষ্কারের জন্যই তিনি দুবার পেলেন নোবেল পুরস্কার। তাঁকে করা হলো সুইডিশ রয়েল একাডেমীর সদস্য।

ফরাসি ইনস্টিটিউট, কেবল এ কারণে যে কোনো মহিলাকে আগে প্রবেশের অধিকার দেয়নি, এজন্য তাঁকে সদস্য করতে অস্বীকার করলো।

তবে ফরাসি সরকার তাঁকে নতুন রেডিয়াম প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিলেন, ১৯১৪ সালে তাঁকে মিলিটারি হাসপাতালের সব রেডিওলজি বিভাগের প্রধান করে নিলেন। 

১৯২৩ সালে ফরাসি সরকার তাঁর জীবনভর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বছরে ৪০,০০০ ফ্রাঙ্ক পেনশন দেবার কথা ঘোষণা করলেন।


মেরি কুরির মৃত্যু

কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়লেন মেরি কুরি। রেডিয়ামের বিকিরণ তার শরীরকে ঝাঝরা করে দিচ্ছিল বছরের পর বছর ধরে। এবার তিনি এই ধ্বংসলীলার শিকার হলেন।

একটি মহৎ জীবনের অবসান হলো। সালটি ১৯৩৪ তারিখ ৪ জুলাই।

ডাক্তাররা পরে বুঝেছিলেন রেডিয়ামের ক্রমাগত তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে তাঁর রক্তে ক্যান্সার বা লিউকেমিয়া হয়েছিল। আর সে রোগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন।


আইরিন কুরি ও ইভ কুরি

পিয়েরে ও মেরির দুই মেয়ে আইরিন ও ইভ কিন্তু খুব খ্যাতি অর্জন করেছিলেন জীবনে। তাঁরাও বেশ বিখ্যাত হয়েছিলেন।

মেয়ে আইরিন ও তার স্বামী ফ্রেডরিক জলিয়ট ও পারমাণবিক গবেষণা করে খ্যাতি পেয়েছিলেন। এই গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য পেলেন নোবেল পুরস্কার। 

মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে হয়ে উঠেছিলেন বড় বিজ্ঞানী। পেলেন রসায়নে নোবেল। ১৯৩৫ সালে অন্য মেয়ে ইভ হয়েছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত লেখিকা।

জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট সয়ে মেরি কুরি ও পিয়েরে কুরি যে আবিষ্কার করেছিলেন এর সুফল পেলেন অনেক মানুষ। 

যে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ তাঁদের ত্বক দগ্ধ করেছিল, ক্রমে ক্রমে এর সংস্পর্শে থেকে থেকে তাঁদের দেহে বাসা বেঁধেছিল ক্যান্সার, সেই বিকিরণই চিকিৎসা হয়ে এলো ক্যান্সারের। বাঁচলো অনেক মানুষের প্রাণ।


পরিশেষে

মানবকল্যাণে আমরা যেমন উজ্জ্বল পদার্থবিজ্ঞানী, অক্লান্ত গবেষক ও প্রথম মহিলা নোবেল বিজয়ী মেরি কুরির অবদানের কথা স্মরণ করবো, সেসঙ্গে তাঁর স্বামী পিয়েরে কুরিকেও মনে রাখবে।

এই ছোটখাটো মহিলা মেরি কুরির ভেতর যে এত আগুন ছিল, তা কে জানতো! বড়ই নম্র ও শান্ত মহিলার অবদান উল্টে দিল পৃথিবীকে।

জীবনের শেষ প্রান্তে আত্মজীবনী লেখার সময় বলেন, “আমার জীবনে ঘটনার ঘনঘটা নেই, এটি সহজ সরল একটি গল্প। আমি জন্মেছিলাম ওয়ারশোর এক শিক্ষক পরিবারে। বিয়ে করেছিলাম পিয়েরে কুরিকে। ছিল দুই মেয়ে। কাজ করেছিলাম ফ্রান্সে।”

বলেছিলেন, “ল্যাবরেটরিতে একজন বিজ্ঞানী কেবল প্রযুক্তিবিদই নয়, সে একজন শিশুর মতোও বটে যে শিশু দেখতে পায় প্রাকৃতিক অনেক ঘটনা, অনেক সময় রূপকথার গল্পের মতো যা তাকে বিমোহিত করে।”

মেরি কুরি যে সর্বকালের প্রসিদ্ধ ও বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের একজন ছিলেন, তাই নয়, তিনি পেয়েছিলেন দু’দুবার নোবেল প্রাইজ এমন এক যুগে যখন মহিলা বিজ্ঞানীদের তেমন কদরই ছিল না।

কি নির্মম মৃত্যু! জুলাই ১৯৩৪ সালে অবসন্ন, ক্লান্ত, প্রায় অন্ধ, মেরি— তাঁর প্রিয় রেডিয়ামের আঘাতে ও প্রহারে দগ্ধ আঙুলগুলো নিয়ে অনন্তলোকের দিকে যাত্রা করলেন। রেখে গেলেন ক্যান্সারের জন্য চিকিৎসা।


সাধারণ তথ্য

মাদাম কুরির উক্তি

ইট’স অলওয়েজ গুড টু ম্যারি ইওর বেস্ট ফ্রেন্ড।

রেডিয়াম আবিষ্কার করেন 

মেরি কুরি


১৮৯৮ সালে মাদাম কুরি ও পিয়ারে কুরি আবিষ্কার করেন

পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম নামের দুটি নতুন মৌলিক পদার্থ।


নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় কত বছর পর পর

নোবেল পুরষ্কার ১ বছর পরপর প্রদান করা হয়।


১ কুরী কত বেকেরেল

কুরি =  3.7 x 104 বেকারেল

বা

কুরি = 3.7 x 104 রাদারফোর্ড = 3.7 x 104 বেকারেল




তথ্য উৎস

  1. https://www.nobelprize.org/prizes/physics/1903/marie-curie/biographical/
  2. https://history.aip.org/exhibits/curie/recdis2.htm
  3. https://www.oxfordreference.com/view/10.1093/oi/authority.20110803095654800
  4. https://www.energy.gov/lm/articles/marie-curie-pioneering-physicist-s-connection-lm
  5. https://www.nobelprize.org/prizes/chemistry/1935/joliot-curie/biographical/
  6. http://www.atomicheritage.org/profile/irene-joliot-curie
  7. http://clinchem.aaccjnls.org/content/clinchem/57/4/653.full.pdf
  8. https://static.springer.com/sgw/documents/1426305/application/pdf/carvalho_marie+curie+and+the+discovery+of+radium.pdf
  9. http://www.csun.edu/~ghe59995/MSE302/2-5%20Marie%20Curie.pdf
  10. https://www.malecircumcision.org/sites/default/files/webform/pdf-marie-curie-and-her-daughters-the-private-lives-of-sciences-fir-shelley-emling-pdf-download-free-book-b47196b.pdf
  11. https://www.bidyapremi.com/2021/10/Marie-Curie.html

মেরি কুরি ও পিয়ের কুরি | কুরি ফ্যামিলি | বিজ্ঞান সাধনায় শ্রেষ্ঠ যে পরিবার

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top