আদিম যুগের মানুষ কৃষিকাজ জানত না। বনে বনে ঘুরে ফলমূল সংগ্রহ করত । তা-ই ছিল তাদের খাদ্য। এরপর মানুষ পাথর ভেঙে ঘষে ঘষে ধারালাে অস্ত্র তৈরি করতে শেখে। সে সময় পাথরই ছিল তাদের একমাত্র হাতিয়ার । সে কারণে এ যুগকে পাথরের যুগ বলা হতাে। পাথর যুগের প্রথম পর্যায়কে বলা হতাে পুরনাে পাথরের যুগ বা পুরােপলীয় যুগ। এ যুগে মানুষ পাথরের অস্ত্র দিয়ে দলবদ্ধভাবে পশু শিকার করত। এরা আগুনের ব্যবহারও জানত।
পুরনাে পাথরের যুগ শেষ হয় মানুষের যাযাবর জীবনের অবসান ঘটিয়ে কৃষিভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এ যুগকে বলা হয় নতুন পাথরের যুগ বা নবােপলীয় যুগ । কৃষির প্রয়ােজনে এ যুগে মানুষ নদীর তীরে বসবাস শুরু করে। ঘর-বাড়ি নির্মাণ করতে শেখে। এভাবেই মানবসভ্যতার রু। এই প্রতিবেদনে কীভাবে মানুষ ধাপে ধাপে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে তারই সত্য কাহিনি, যাকে আমরা বলি ইতিহাস- সে বিষয়ে আলােচনা করা হবে।
মিশরীয় সভ্যতা (Egyptian civilization)
মিশরীয় সভ্যতার পটভুমি: Background of Egyptian civilization
আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর-পূর্ব অংশে বর্তমানে যে দেশটির নাম ইজিপ্ট, সেই দেশেরই প্রাচীন নাম মিশর। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ৩২০০ অব্দ পর্যন্ত নীল নদের অববাহিকায় একটি সমৃদ্ধ জনপদের উদ্ভব হয়। এ সময় থেকে মিশর প্রাচীন সভ্যতায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে শুরু করে।
এরপর ৩২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে প্রথম রাজবংশের শাসন আমল শুরু হয়। ঐ সময় থেকে মিশরের ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়। একই সময়ে নারমার বা মেনেস হন একাধারে মিশরের প্রথম নরপতি এবং পুরােহিত। তিনি প্রথম ফারাও-এর মর্যাদাও লাভ করেন।
এরপর থেকে ফারাওদের অধীনে মিশর প্রাচীন বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতিতে একের পর এক উল্লেযােগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়।
মিশরীয় সভ্যতা: ভৌগােলিক অবস্থান (Egyptian Civilization: Geographical Location)
তিনটি মহাদেশ দ্বারা ঘিরে থাকা মিশরের ভৌগােলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশটি এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরােপ মহাদেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত ভূমধ্যসাগরের উপকূলে অবস্থিত। এর উত্তরে ভূমধ্যসাগর, পূর্বে লােহিত সাগর, পশ্চিমে সাহারা মরুভূমি,দক্ষিণে সুদান ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশ। এর মােট আয়তন প্রায় চার লক্ষ বর্গমাইল।
মিশরীয় সভ্যতা: সময়কাল (Egyptian Civilization: Period)
মিশরীয় সভ্যতা ২৫০০ বছরেরও বেশি সময়ব্যাপী স্থায়ী হয়েছিল। প্রাচীন মিশরের নিরবচ্ছিন্ন ও দীর্ঘ ইতিহাসের সূচনা হয় ৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। বিশেষ করে নবােপলীয় যুগে।
তবে মিশরীয় সভ্যতার গােড়াপত্তন হয় মেনেসের নেতৃত্বে, যা প্রায় তিন হাজার বছর ধরে স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব দশম শতকে লিবিয়ার এক বর্বর জাতি ফারাওদের সিংহাসন দখল করে নেয়। ৬৭০-৬৬২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে অ্যাসিরীয়রা মিশরে আধিপত্য বিস্তার করে।
৫২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পারস্য মিশর দখল করে নিলে প্রাচীন মিশরের সভ্যতার সূর্য অস্তমিত হয়।
মিশরীয় সভ্যতা: রাষ্ট্র ও সমাজ (Egyptian Civilization: State and Society)
প্রাক-রাজবংশীয় যুগে মিশর কতকগুলাে ছােট নগর রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। এগুলােকে ‘নােম’ বলা হতাে। মিশরের প্রথম রাজা বা ফারাও (মেনেস বা নারমার) সমগ্র মিশরকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ অব্দে ঐক্যবদ্ধ করে একটি রাজ্য গড়ে তােলেন, যার রাজধানী ছিল দক্ষিণ মিশরের মেফিসে।
তখন থেকে মিশরে ঐক্যবদ্ধ রাজ্য ও রাজবংশের উদ্ভব । মিশরীয় ‘পের-ও’ শব্দ থেকে ফারাও শব্দের জন্ম। ফারাওরা ছিল অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। তারা নিজেদের সূর্য দেবতার বংশধর মনে করত।
ফারাও পদটি ছিল বংশানুক্রমিক। অর্থাৎ ফারাওয়ের ছেলে হতাে উত্তরাধিকার সূত্রে ফারাও। পেশার ওপর ভিত্তি করে মিশরীয়দের কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন-
- রাজপরিবার,
- পুরােহিত,
- অভিজাত,
- লিপিকার,
- ব্যবসায়ী,
- শিল্পী এবং
- কৃষক ও ভূমিদাস শ্রেণি।
মিশরের অর্থনীতি মূলত ছিল কৃষিনির্ভর। উৎপাদিত ফসলের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল গম, যব, তুলা, পেঁয়াজ, পিচফল ইত্যাদি। ব্যবসা-বাণিজ্যেও মিশর ছিল অগ্রগামী।
মিশরে উৎপাদিত গম, লিনেন কাপড় ও মাটির পাত্র ক্রিট দ্বীপ-ফিনিশিয়া-ফিলিস্তিন ও সিরিয়ায় রপ্তানি হতাে। বিভিন্ন-দেশ থেকে-মিশরীয়রা স্বর্ণ-রৌপ্য, হাতির-দাঁত, কাঠ-ইত্যাদি নিয়মিত-আমদানি করত।
মিশরীয় সভ্যতা: নীল নদ (Egyptian Civilization: The Nile River)
মিশরের নীল নদের উৎপত্তি আফ্রিকার লেক ভিক্টোরিয়া থেকে। সেখান থেকে নদটি নানা দেশ হয়ে মিশরের মধ্য দিয়ে ভূ-মধ্যসাগরে এসে পড়েছে।
ইতিহাসের জনক হেরােডােটাস যথার্থই বলেছেন- ‘মিশর নীল নদের দান। নীল নদ না থাকলে মিশর মরুভূমিতে পরিণত হতাে। প্রাচীনকালে প্রতিবছর নীল নদে বন্যা হতাে। বন্যার পর পানি সরে গেলে দুই তীরে পলিমাটি পড়ে জমি উর্বর হতাে। জমে থাকা পলিমাটিতে জন্মাতাে নানা ধরনের ফসল।
মিশরীয় সভ্যতা: সভ্যতায় মিশরীয়দের অবদান (Egyptian Civilization: The Contribution of Egyptians to Civilization)
প্রাচীন সভ্যতায় মিশরীয়দের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। ধর্মীয় চিন্তা, শিল্প, ভাস্কর্য, লিখন পদ্ধতি,কাগজের আবিষ্কার, জ্ঞান বিজ্ঞানচর্চা—সবকিছুই তাদের অবদানে সমৃদ্ধ।
মিশরীয়দের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, তাদের জীবন ধর্মীয় চিন্তা ও বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
মিশরীয় সভ্যতা: মিশরীয়দের ধর্মবিশ্বাস (Egyptian civilization: The religion of the Egyptians)
সম্ভবত প্রাচীন মিশরীয়দের মতাে অন্য কোনাে জাতি জীবনের সকল ক্ষেত্রে এতটা ধর্মীয় নিয়ম-কানুন অনুশাসন দ্বারা প্রভাবিত ছিল না। সে কারণে মানবসভ্যতার অনেক ধ্যানধারণা, রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠানের জন্ম প্রাচীন মিশরে ।
তারা জড়বস্তুর পূজা করত, মূর্তি পূজা করত, আবার জীবজন্তুর পূজাও করত। বিভিন্ন সময়ে তাদের ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটেছে। মিশরীয়দের ধারণা ছিল- সূর্যদেবতা ‘রে’ বা ‘আমন রে’ এবং প্রাকৃতিক শক্তি, শস্য ও নীল নদের-দেবতা ‘ওসিরিস’ মিলিতভাবে-সমগ্র পৃথিবী-পরিচালিত-করেন। তবে, তাদের জীবনে-সূর্যদেবতা ‘রে’- এর গুরুত্ব-ছিল-অনেক বেশি।
মিশরীয়রা মনে করত মৃত ব্যক্তি আবার একদিন বেঁচে উঠবে। সে কারণে দেহকে তাজা রাখার জন্য তারা মমি করে রাখত । এই চিন্তা থেকে মমিকে রক্ষার জন্য তারা পিরামিড তৈরি করেছিল। ফারাওরা স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে দেশ শাসন করত। তারা ছিল প্রধান পুরােহিত এবং অন্যান্য পুরােহিতকেও তারা নিয়ােগ করত।
মিশরীয় সভ্যতা: শিল্প (Egyptian Civilization: Art)
মিশরীয়দের চিত্রকলা বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য দেশের মতাে চিত্রশিল্পও গড়ে উঠেছিল ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে। তারা সমাধি আর মন্দিরের দেয়াল সাজাতে গিয়ে চিত্রশিল্পের সূচনা করে। তাদের প্রিয় রং ছিল সাদা-কালাে ।
সমাধি, পিরামিড, মন্দির, প্রাসাদ, প্রমােদ কানন, সাধারণ ঘর-বাড়ির দেয়ালে মিশরীয় চিত্রশিল্পীরা অসাধারণ ছবি এঁকেছেন। সেসব ছবির মধ্যে সমসাময়িক মিশরের রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের কাহিনি ফুটে উঠেছে।
কারুশিল্পেও প্রাচীন মিশরীয় শিল্পীরা অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। আসবাবপত্র, মৃৎপাত্র, সােনা, রুপা, মূল্যবান পাথরে খচিত তৈজসপত্র, অলঙ্কার, মমির মুখােশ, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র, হাতির দাঁত ও ধাতুর দ্রব্যাদি মিশরীয় কারু শিল্পের দক্ষতার প্রমাণ বহন করে।
মিশরীয় সভ্যতা: ভাস্কর্য (Egyptian Civilization: Sculpture)
ভাস্কর্য শিল্পে মিশরীয়দের মতাে প্রতিভার ছাপ আর কেউ রাখতে সক্ষম হয়নি। ব্যাপকতা, বৈচিত্র্য এবং ধর্মীয় ভাবধারায় প্রভাবিত বিশাল আকারের পাথরের মূর্তিগুলাে ভাস্কর্য শিল্পে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে।
প্রতিটি ভাস্কর্য ধর্মীয় ভাবধারা, আচার অনুষ্ঠান, মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। প্রতিটি শিল্পই ছিল আসলে ধর্মীয় শিল্পকলা। সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য হচ্ছে গিজার অতুলনীয় স্ফিংক্স। স্ফিংক্স হচ্ছে এমন একটি মূর্তি, যার দেহ সিংহের মতাে, কিন্তু মুখ মানুষের মতাে।
মিশরের সবচেয়ে বড় পিরামিড হচ্ছে ফারাও খুফুর পিরামিড। মন্দিরগুলােতে মিশরীয় ভাস্কর্য স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন প্রতিফলিত হয়েছে।
মিশরীয় সভ্যতা: লিখনপদ্ধতি ও কাগজ আবিষ্কার (Egyptian Civilization: Writing Methods and Paper Discovery)
মিশরীয় সভ্যতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল লিপি বা অক্ষর আবিষ্কার। নগর সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মিশরীয় লিখনপদ্ধতির উদ্ভব ঘটে। পাঁচ হাজার-বছর-পূর্বে-তারা সর্বপ্রথম ২৪টি ব্যঞ্জনবর্ণের-বর্ণমালা আবিষ্কার-করে।
প্রথম দিকে ছবি এঁকে তারা মনের ভাব প্রকাশ করত। এই লিখন পদ্ধতির নাম ছিল চিত্রলিপি।এই চিত্রলিপিকে বলা হয় ‘হায়ারােগ্লিফিক‘ বা পবিত্র অক্ষর। মিশরীয়রা নলখাগড়া জাতীয় গাছের কাণ্ড থেকে কাগজ বানাতে শেখে। সেই কাগজের ওপর তারা লিখত।
গ্রিকরা এই কাগজের নাম দেয় ‘প্যাপিরাস। এই শব্দ থেকে ইংরেজি পেপার শব্দের উৎপত্তি। এখানে উল্লেখ্য, নেপােলিয়ান বােনাপার্টের মিশর জয়ের সময় একটি পাথর আবিস্কৃত হয় যা রসেটা স্টোন নামে পরিচিত। যাতে গ্রিক এবং‘হায়ারােগ্লিফিক ভাষায় অনেক লেখা ছিল, যা থেকে প্রাচীন মিশরের অনেক তথ্য জানা যায় ।
মিশরীয় সভ্যতা: বিজ্ঞান (Egyptian Civilization: Science)
মিশরীয় সভ্যতা ছিল কৃষিনির্ভর। সে কারণে নীল নদের প্লাবন, নাব্য, পানিপ্রবাহের মাপ জোয়ার-ভাটা ইত্যাদি ছাড়াও জমির মাপ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এসবের সঙ্গে জ্যোতিষশাস্ত্র ও অঙ্কশাস্ত্রের ছিল গভীর যােগাযােগ। ফলে এ দুইটি বিদ্যা তারা আয়ত্ত করেছিল প্রয়ােজনের তাগিদে।
তারা অঙ্কশাস্ত্রের দুইটি শাখা জ্যামিতি এবং পাটিগণিতেরও প্রচলন করে। মিশরীয় সভ্যতার মানুষ যােগ, বিয়ােগ ও ভাগের ব্যবহার জানত। ৪২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তারা প্রথম সৌর পঞ্জিকা আবিষ্কার করে। ৩৬৫ দিনে বছর এ হিসাবের আবিষ্কারকও তারা। প্রাচীন মিশরের অধিবাসীরা সময় নির্ধারণের জন্য সূর্যঘড়ি, ছায়াঘড়ি, জলঘড়ি আবিষ্কার করে।
Conclusion:
ধর্মের কারণে মিশরীয়রা বিজ্ঞানচর্চায় আগ্রহী ছিল। তারা পরলােকে বিশ্বাস করত এবং ফারাওরা পরবর্তী জন্মেও রাজা হবেন এই বিশ্বাস তাদের ছিল। তাই তারা ফারাওদের দেহ তাজা রাখার পদ্ধতি আবিষ্কার করে। এ কারণেই মমি তৈরি শুরু হয়।
মিশরীয় বিজ্ঞানীরা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় মৃতদেহ পচন থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হন। চিকিৎসাশাস্ত্রেও প্রাচীন মিশরীয়রা বিশেষ অগ্রগতি লাভ করেছিল। তারা চোখ, দাঁত, পেটের রােগ নির্ণয় করতে জানত।
অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চিকিৎসা করার বিদ্যাও তাদের জানা ছিল। তারা হাড় জোড়া লাগানাে, হৃৎপিণ্ডের গতি এবং নাড়ির স্পন্দন নির্ণয় করতে পারত। মিশরীয়রা দর্শন ও সাহিত্যচর্চা করত। তাদের রচনায় দুঃখ-হতাশার কোনাে প্রকাশ ছিল না। তারা-আশাবাদী ছিল। তাদের-লেখায় সব-সময়ই আনন্দের-প্রকাশ দেখা-গেছে।