মনোভাব কি ? মনোবিজ্ঞান (What is attitude? Psychology)

ক্ষুধা ও তৃষ্ণা যেমন প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আছে, তেমনই প্রত্যেক মানুষেরই কোনো না কোনো মনোভাবও আছে। মা, বাবা, বন্ধু-বান্ধব, কবি, সাহিত্যিক, বিশ্বশান্তি, সন্ত্রাস প্রভৃতির প্রতি বিশেষ বিশেষ মনোভাব রয়েছে। মনোভাবকে আমরা ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দ বলতে পারি।

কেউ হয়তো চা পান করতে খুব ভালোবাসে, কেউ আবার চা একেবারেই পছন্দ করে না। এক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, প্রথম ব্যক্তির চায়ের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব এবং দ্বিতীয় ব্যক্তির নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে।

পরিবেশের বিভিন্ন ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার মনোভাব গড়ে উঠে এবং তা তার জীবনকে প্রভাবিত করে।

মনোভাব কি ? মনোবিজ্ঞান (What is attitude? Psychology)

Nature of Attitude

সমাজ মনোবিজ্ঞানীদের অনেকে মনোভাবকে এক প্রকার দৈহিক প্রস্তুতি, স্নায়ু ও পেশিতন্ত্রের কর্মপ্রবণতা হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষপাতী। এদের মতে মনোভাব হলো বিশেষ একটি দিকে ক্রিয়া করার দৈহিক প্রস্তুতি।

কিছু সংখ্যক সমাজ মনোবিজ্ঞানী আবার মনোভাবকে দৈহিক প্রস্তুতি হিসেবে বর্ণনা করতে আগ্রহী নন। এরা মনোভাবকে মানসিক প্রস্তুতি বলে গণ্য করার পক্ষপাতী ।

মনোভাবের যে সকল সংজ্ঞার্থ প্রচলিত আছে তাদের প্রত্যেকটিতে কোন বিষয়ের প্রতি ‘প্রবণতা’, কিংবা কোন বিষয় সম্পর্কে ‘প্রস্তুতি’, অথবা কোন বিষয়ের সাথে ‘সঙ্গতিসাধন’ ইত্যাদির কথার উল্লেখ করা হয়েছে।

যে ভাষাই উল্লেখ করা হোক না কেন, মনোভাবের স্বরূপধর্ম যে এক তা স্বীকার করা হয়েছে। অর্থাৎ মনোভাব হলো ‘প্রস্তুতিমূলক সক্রিয়তা’- এ বিষয়ে সমাজ মনোবিজ্ঞানীরা একমত।

আলপোর্ট (Allport, 1935)-এর সংজ্ঞানুযায়ী, “মনোভাব হচ্ছে ব্যক্তির অতীত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সংগঠিত মানসিক স্নায়বিক প্রস্তুতি যা ব্যক্তিকে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে বিশেষ ভঙ্গিতে প্রতিক্রিয়া করতে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে।”

মারফি, মারফি ও নিউকোষ (Murphy G., Murphy L. and Newcomb T., 1937) বলেন, “মনোভাব হলো কোন কিছুর পক্ষে বা বিপক্ষে যাবার পূর্ব প্রস্তুতি।”

রোজেনবার্গ (Rosenberg, 1950)-এর মতে, “মনোভাব হলো কোনো বিষয় বা বস্তুর প্রতি ব্যক্তি অপেক্ষাকৃত স্থায়ী ক্রিয়াশীল প্রতিক্রিয়া।”

জিম্বার্ডো ও এবেসেন (Zimbardo and Ebbesen, 1970) বলেন, “মনোভাব হলো অবহিতি ও অনুভূতির মধ্যে সঙ্গতিপূর্ণ আচরণ করবার প্রবণতা।”

কোনো বিশেষ সামাজিক পরিস্থিতি, বিশেষ কোনো শ্রেণিভুক্ত ব্যক্তি অথবা বিশেষ কোনো গোষ্ঠী, সামাজিক কোনো সমস্যা ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের চিন্তা, অনুভূতি এবং প্রতিক্রিয়ার পূর্বাপর সঙ্গতিসম্পন্ন রীতিকেই মনোভাব বলা হয়।

চিন্তা, বিশ্বাস, অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া করার প্রবণতা নিয়েই মনোভাব গঠিত হয়। কাজেই মনোভাব হলো বিশেষ অবস্থায় ধরনের ব্রনের প্রতিক্রিয়া করার প্রবণতা।

মনোভাবের বৈশিষ্ট্যাবলি (Characteristics of Attitude)


আমাদের পরিবেশের বিশেষ একটি বিষয়ে আমরা যে বিশিষ্ট আচরণ করি তা আমাদের মনোভাবে দ্বারা নির্ধারিত হয়। সমাজ মনোবিজ্ঞানী শেরিফ (Sherif) মনোভাবের কতগুলো বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন। নিম্নে এগুলো আলোচনা করা হলো:

  1. মনোভাব জন্মগত নয়। বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যক্তির অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে পারস্পরিক ক্রিয়া অর্থাৎ মিথস্ক্রিয়ার ভিতর দিয়ে মনোভাব অর্জিত হয়। মনোভাবের জৈবিক ভিত্তি থাকলেও মনোভাব কিন্তু জৈবিক চাহিদা থেকে উদ্ভূত নয়।
  2. মনোভাব মোটামুটি দীর্ঘস্থায়ী। মনোভাব ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হয় না। তবে মনোভাব যেহেতু জন্মগত নয়, অভিজ্ঞতার প্রভাবে অর্জিত, সেহেতু অভিজ্ঞতার পরিবর্তনের ফলে মনোভাবের পরিবর্তন হতে পারে।
  3. মনোভাব সর্বদাই ব্যক্তির সাথে তার পরিবেশের একটি বিশেষ পরিস্থিতির সম্পর্ককে বোঝায়। এ বিশেষ পরিস্থিতি কোনো বস্তু, কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংস্থা কিংবা কোনো মূল্যবোধও হতে পারে।
  4. আমাদের সামাজিক মনোভাবের আওতায় শুধু ব্যক্তি নয়, ক্ষুদ্র ও বৃহৎ গোষ্ঠীও থাকতে পারে। যেমন এক পাড়ার গুণ্ডাদল অপর পাড়ার গুণ্ডাদল সম্পর্কে বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করে।
  5. মনোভাব সর্বদাই লক্ষ্যাভিমুখী। উদ্দেশ্য মনোভাব অপেক্ষা স্বল্পকাল স্থায়ী একটি মানস দৈহিক প্রস্তুতিমূলক অবস্থা। উদ্দেশ্যের তৃপ্তি সাধন করা যায়, কিন্তু মনোভাব প্রকাশ করা চলে। উদ্দেশ্য মূলত ইচ্ছামূলক সক্রিয়তা; অপরপক্ষে মনোভাব মূলত জ্ঞানমূলক বা অবগতিমূলক।
  6. মনোভাবের সাথে অনুভূতি ও আবেগ জড়িত। আমরা সাধারণত বলে থাকি-অমুকের প্রতি আমার স্নেহের মনোভাব আছে, কিংবা বিদ্বেষের কিংবা ভয়ের মনোভাব আছে। আবেগ একটি বিক্ষুব্ধ অবস্থা, কিন্তু মনোভাব সর্বদা প্রচ্ছন্ন অবস্থা।
  7. মনোভাব প্রচ্ছন্ন থাকে বলে সোজাসুজি মনোভাবকে জানা যায় না। ব্যক্তির কথা বার্তা ও আচরণ থেকে তার মনোভাব সম্পর্কে পরোক্ষ জ্ঞান হয়।


মনোভাব ও মতামত (Attitude and Opinion)

মনোভাব ও মতামত একই অর্থে ব্যবহৃত হলেও মনোবিজ্ঞানিগণ উভয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছেন। থার্সটোন (১৯৬৪) মনোভাবকে একটি মানসিক বিষয়বস্তুর প্রতি ঋণাত্মক বা ঋণাত্মক মাত্রা বলে আখ্যায়িত করেছেন।

মনোভাব হলো অবহিতি ও অনুভূতির মধ্যে সঙ্গতিপূর্ণ আহ্বান করার প্রবণতা। আবার কেউ কেউ বলেছেন মনোভাব হলো বিশেষ একটি দিকে ক্রিয়া করার দৈহিক প্রস্তুতি।

রাকিচের (১৯৬৮) মতে, “শত শত বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসগুলো গুচ্ছতা ধারণ করে মনোভাব গঠিত হয় এবং শতশত মনোভাব সুসংগঠিত হয়ে ব্যক্তির মধ্যে কয়েকটি মূল্যবোধের তৈরি হয়।”

মনোভাবের উপাদান (The element of attitude)


মনোভাবের মধ্যে তিনটি প্রধান উপাদান রয়েছে। যথা:

  1.  জ্ঞান বা অবহিতিমূলক,
  2. অনুভূতিমূলক,
  3. ক্রিয়ামূলক।

জ্ঞান বা অবহিতিমূলক উপাদান (Cognitive component)

কোনো বিশেষ বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞানই হচ্ছে মনোভাবের অবহিতিমূলক উপাদান। মনোভাব সম্পর্কিত ভালো বা মন্দ, অনুকূল বা প্রতিকূল অথবা কাঙ্ক্ষিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত লক্ষণই হলো জ্ঞান বা অবহিতিমূলক উপাদান।

উদাহরণস্বরূপ, ক্লাসে কোনো শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। কারণ উক্ত শিক্ষকের জ্ঞান, তার বোঝানোর ক্ষমতা, তার দক্ষতার প্রতি ঐ ছাত্রের ইতিবাচক ক্ষমতা রয়েছে।

অনুভূতিমূলক উপাদান (Feeling component)


মনোভাবের সাথে জড়িত আবেগকেই অনুভূতিমূলক উপাদান বলা যায়। এ আবেগের ওপর ভিত্তি করেই মনোভাবের বিষয় সম্বন্ধে ব্যক্তির পছন্দ ও অপছন্দ গড়ে উঠে।

ক্লাসে কোনো শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। তার অর্থ হলো এই যে, উক্ত শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের ভালো লাগা বা পছন্দের সম্পর্ক রয়েছে। উক্ত শিক্ষকের কাজকর্মের প্রতি ছাত্রের আবেগ কাজ করছে।

ক্রিয়ামূলক উপাদান (Action component)


মনোভাব সম্পর্কিত ব্যক্তির সকল প্রকার আচরণকেই মনোভাবের ক্রিয়ামূলক উপাদান বলে। কোনো বস্তু বা ব্যক্তির প্রতি ইতিবাচক মনোভাব হলে সে তাকে রক্ষা করবে এবং তার মঙ্গল কামনা করবে। আর নেতিবাচক হলে সে তার ধ্বংস ও ক্ষতিসাধন করবে।

উপরোক্ত উদাহরণে, উক্ত শিক্ষকটির প্রতি কেউ বিরূপ সমালোচনা করলে ছাত্র তা খণ্ডন করার চেষ্টা করবে অথবা শিক্ষক কোনো সমস্যায় পড়লে ছাত্রটি ঠিক শিক্ষকের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। এগুলোই হলো মনোভাবের ক্রিয়াগত দিক।

কোনো কোনো মনোবিজ্ঞানী বিশেষত ফ্রিডম্যান ও সাথীরা (১৯৮১) মন্তব্য করেছেন যে, এ সকল তিনটি উপাদানই একত্রে মনোভাব গঠন করে। তবে সবচেয়ে বেশি সাধারণ সমসাময়িক সংজ্ঞা বিবেচনা করে যে, একটি মনোভাব মূল্যায়নকৃত বা অনুভূতিমূলক উপাদানের সাথে জড়িত।

মনোভাবের মৌখিক প্রকাশকে মতামত বলে। মনোভাব ও মতামত এক বিষয় নয়—তবে একে অপরের সাথে জড়িত।

মতামত কথাটির মধ্যে বিশ্বাসের একটা সুর আছে। বিভিন্ন প্রকারের বিশ্বাস থাকতে পারে। তবে মতামতের মধ্যে যে বিশ্বাসের ভাব আছে তা একটি বিতর্কমূলক বিষয় সম্পর্কে বিশ্বাস।

বিশ্বাস হচ্ছে একটি সমস্যা সম্পর্কিত এবং যার অনেকগুলো বিপরীতধর্মী বিশ্বাস থাকতে পারে। মতামত হচ্ছে একটি বিপরীতধর্মী বিষয় সম্পর্কে কতগুলো বিশ্বাস।

সুতরাং কোনো একটি বিতর্কমূলক বিষয় সম্পর্কে একাধিক বিশ্বাসকে মতামত বলা হয়। মতামতে অবহিতি বা জ্ঞানীয় উপাদান প্রধান ভূমিকা পালন করে।

একজন ব্যক্তির মতামত একটি সমস্যা অথবা একটি বিষয় সম্পর্কে অনুকূল বা প্রতিকূল হতে পারে। মনোভাব ও মতামত এ দুটি ধারণা সাধারণভাবে প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে।

তবে মনোভাব ও মতামত এক জিনিস নয়। মনোভাব হলো কোনো আচরণ করার প্রবণতা; মতামত হলো মনোভাবের বাচনিক প্রকাশ। মনোভাব মানুষের ব্যক্তিত্বের গভীরে নিবিড়ভাবে প্রোথিত এবং বিশেষ ভঙ্গিতে আচরণ করার একটা মোটামুটি স্থায়ী প্রবণতা।

আর মতামতের অবস্থান চেতন মনের কাছাকাছি এবং মতামত অপেক্ষাকৃত স্বল্পস্থায়ী। কেউ কেউ বলেন, মনোভাবের বাহ্যিক শব্দগত প্রকাশই হচ্ছে মতামত অর্থাৎ মনোভাব মতামতের আকারে ব্যক্ত হয়।

এদিক থেকে বলা যায়, মতামত হলো একটি বিতর্কিত বিষয় সম্পর্কে ব্যক্তি মনোভাবের পরিচায়ক বাচিক প্রতিক্রিয়া।

মনোভাবের গঠন (Formation of Attitudes)


সামাজিক শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মনোভাব গঠিত হয়। মনোভাবের গঠনে শিক্ষণের মূলনীতিগুলো যেমন, চিরায়ত সাপেক্ষণ, করণ শিক্ষণ, অনুকরণ প্রভৃতি বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

প্যাভলভের চিরায়ত সাপেক্ষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করে আর্থার স্ট্যাটস ও তার সহযোগীবৃন্দ (১৯৫৮) মনোভাবের ক্ষেত্রে শিক্ষণের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তারা বলেন, যদি মনোভাব সৃষ্টিকারী কোনো ঘটনার সাথে একটি উদ্দীপককে যুগপভাবে কয়েকবার উপস্থাপন করা যায়, তাহলে ঐ উদ্দীপকটি পরবর্তী সময়ে উল্লেখিত মনোভাব উদ্রেক করবে।

মনোভাব গঠনের ক্ষেত্রে করণ শিক্ষণও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। করণ শিক্ষণে মূল শর্ত হলো সন্তুষ্টি বা পুরস্কার লাভ। কোনো শিশুকে যদি বলা হয়, সে সত্য কথা বললে তাকে পুরস্কার দেয়া হবে এবং মিথ্যা বললে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।

দেখা যাবে যে, শিশুটি পুরস্কার লাভের জন্য সত্য কথা বলেছে। আবার অনুকরণ-এর মাধ্যমেও মনোভাব গঠিত হতে পারে। ছোট শিশুরা তাদের বাবা-মা যাকে ভালো বলেন তাকে ভালো ভাবতে শিখে এবং যে কাজটি নিন্দা করেন তাকে খারাপ ভাবতে শুরু করে।

মনোভাব গঠনে যে সকল অবস্থা বিশেষভাবে কাজ করে তা আলোচনা করা হলো:

১. ব্যক্তির চাহিদা পূরণ (Demand)

ব্যক্তির চাহিদা পূরণের সাথে মনোভাব গঠনের সম্পর্ক রয়েছে। যে ব্যক্তি বা বস্তু ব্যক্তির মনোভাব গঠনে সহায়তা করে তার প্রতি ব্যক্তির ইতিবাচক মনোভাব ও যা তার মনোভাব গঠনে বাধার সৃষ্টি করে তার প্রতি তার একটি প্রতিকূল মনোভাব গড়ে উঠে।

ডাক্তারের প্রতি রোগীর অনুকূল মনোভাব পাওয়া যায় যদি ডাক্তারের পরামর্শে রোগটি সেরে যায়। কিন্তু যদি ডাক্তারের পরামর্শে বা ওষুধপত্রে কোনো কাজ না হয় তাহলে ডাক্তারের প্রতি প্রতিকূল মনোভাব গড়ে উঠে।

২. তথ্য পরিবেশন (Information)

ব্যক্তির নিকট যে তথ্য পরিবেশিত হয় তার ওপর ভিত্তি করে ঐ ব্যক্তির মনোভাব গড়ে উঠে। কোনো ব্যক্তির যুদ্ধ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। কাজেই যুদ্ধ সম্পর্কে তার কোনো অনুকূল বা প্রতিকূল মনোভাব থাকার কথা নয়। 
যদি আধুনিক যুদ্ধের ভয়াবহতার সম্পর্কে টেলিভিশনে এমন তথ্য পরিবেশন করা হয় যাতে যুদ্ধের ভয়াবহতা ফুটে উঠে এবং যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ, যুদ্ধের আবহাওয়া, করুণ পরিণতি প্রভৃতি সকল তথ্য পরিবেশন করা হয় তাহলে ঐ ব্যক্তির যুদ্ধ সম্পর্কে প্রতিকূল মনোভাব গড়ে উঠবে।

৩. সমিতি (Club)

কোনো ব্যক্তি যে সমিতির সদস্য হয় সে সেই সমিতির নিয়ম-নীতি মেনে চলে। প্রতিটি সমিতি বা সংঘের নিজস্ব কতগুলো রীতি-নীতি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ থাকে। কোনো ব্যক্তি যে সংঘের সদস্য হয়, তাকে ঐ সংঘের নিয়ম-কানুন মেনে অন্যান্য সদস্যদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মনোভাব গড়ে তোলে।

৪. ব্যক্তিত্ব (Personality)

ব্যক্তিত্ব হলো ব্যক্তির সকল বৈশিষ্ট্যের সামগ্রিক রূপ যার ভেতর দিয়ে প্রকাশ পায় তার স্বাতন্ত্র্য ভাব। মনোভাব গঠনে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এডোরনো ও তার সাথীরা (Adorno, et.al. ১৯৫০) দেখিয়েছেন যে, ব্যক্তির রাজনৈতিক ও সামাজিক ধারণাগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এগুলো ব্যক্তিত্বের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।

ম্যাকক্লোসকি (Mc Closky, ১৯৫৮) তার পরীক্ষণে দেখতে পান যে, উদারনৈতিক (Liberal) রাজনীতি শিক্ষিত ও উঁচুদরের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দেখা যায় এবং গোড়ামি (Conservative) রাজনৈতিক মনোভাব কম শিক্ষিত, কম জ্ঞানী ও অল্প বুদ্ধিসম্পন্নদের মধ্যে দেখা যায়।

৫. পরিবার (Family)

মনোভাব গঠনে পরিবারের অবদানও গুরুত্বপূর্ণ। পিতামাতা তাদের নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ, সংস্কার, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আগ্রহ ইত্যাদি তাদের শিশু সন্তানের মধ্যে সংক্রমিত করেছেন।

শিশু নিজেকে নিবিড়ভাবে তার পিতামাতার সাথে একাত্ম করে ফেলে এবং পিতামাতাকে অনুকরণীয় আদর্শ বলে মনে করে। শিশুর বিচার-বিবেচনার শক্তি কম থাকায় পরিবারে যেসব আচরণ ও মূল্যবোধ প্রচলিত, শিশু নির্বিচারে তাই গ্রহণ করে।

৬. সংস্কৃতি (Culture)

প্রত্যেক সংস্কৃতিতে বা জীবনধারায় শিশু পালনের একটি বিশেষ পদ্ধতি থাকে। এর ফলে সাংস্কৃতিক প্রভাবে শিশুর মধ্যে কতগুলো মনোভাব গড়ে উঠে। বিদ্যালয় যে শিক্ষা দান করে তা একটি নির্দিষ্ট মতবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষা।

কাজেই শিক্ষার মধ্যে নির্দিষ্ট একটি মতবাদে দীক্ষা দেবার প্রচেষ্টা থাকে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মনোভাবও সেভাবে গড়ে ওঠে। শিক্ষকের মনোভাবের প্রভাবও অস্বীকার করা যায় না।

আবার বিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের মনোভাবের প্রভাবেও শিক্ষার্থীর মনোভাব গঠিত হয়। আমাদের খেলাধুলা, আমাদের পাঠ্যপুস্তক, আমরা যে ধরনের বন্ধুদের সঙ্গে মিশি, যেসব আমোদ প্রমোদে যোগদান করি, যে সংবাদপত্র পড়ি, রেডিওতে যা শুনি ইত্যাদি সব কিছুই আমাদের মনোভাব গঠনে সাহায্য করে।

আমরা কতগুলো প্রভাবের কাছে নতি স্বীকার করি, আবার কতগুলো প্রভাব আমাদের ওপর কোনো কাজই করতে পারে না। এর কারণ আমাদের ব্যক্তিত্বের প্রলক্ষণ।

অপরের কোনো মনোভাব আমাদের ব্যক্তিত্বের বিরোধী হলে আমরা উক্ত মনোভাব গ্রহণ করি না এবং সম্ভব হলে সেই ব্যক্তির সান্নিধ্য পরিহার করে চলি। মোট কথা, মনোভাব আপনা-আপনি গড়ে উঠে না।

আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের ভেতর দিয়ে মনোভাব গড়ে উঠে। মনোভাব গঠনে মানসিক ও বাহ্য উভয়রূপ উপাদানের প্রভাব স্বীকার্য। ব্যক্তির উদ্দেশ্য, চাহিদা, আদর্শ ইত্যাদি এবং ব্যক্তির অভিজ্ঞতা, অপরের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যাদি এই উভয় প্রকার উপাদানের ক্রিয়ার ফলে মনোভাব গঠিত হয়।

মনোভাবের বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, মনোভাব জন্মগত নয়, শিক্ষার দ্বারা মনোভাব অর্জিত হয়। রস স্ট্যাগনার (Rosis Stagner) মনোভাব গঠনের চারটি শর্তের উল্লেখ করেছেন। যথা-

  1. সমাকলন (integration),
  2. পৃথকীকরণ (differentiation),
  3. মানসিক আঘাত (trauma) এবং
  4. গ্রহণ (adoption)

রস স্ট্যাগনার এ চারটি শর্ত কীভাবে কাজ করছে তা উদাহরণের সাহায্যে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি রাশিয়ার জনগণ কীভাবে কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিল তার বিবরণ দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, কিছু লোক জার-শাসনের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে ধীরে ধীরে কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিল (সমাকলন)।

কিছু সংখ্যক লোক অস্বাভাবিক ধরনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার ফলে রাতারাতি কমিউনিস্টদের প্রতি অনুকূল হয়ে পড়েছিল (মানসিক আঘাত)।

কিছু সংখ্যক লোক একটা অনির্দিষ্ট অসন্তোষ ভোগ করছিল এবং প্রগতিবাদী আদর্শের প্রতি যাদের আগ্রহ ছিল তারা কমিউনিস্ট ক্রিয়াকলাপের মধ্যে এসব অসন্তোষ দূরীকরণের উপায় এবং প্রগতিবাদী আদর্শের মূর্ত রূপ প্রত্যক্ষ করার ফলে কমিউনিস্ট হয়ে পড়েছিল (পৃথকীকরণ)।

কিছু সংখ্যক লোক আবার তাদের বন্ধু, শিক্ষক, পিতা-মাতার আদর্শের অন্ধ অনুকৃতির ফলে কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিল (গ্রহণ)।

অন্যান্য ব্যক্তি সংস্পর্শে এবং গোষ্ঠীর নৈতিক রীতিনীতির সংস্পর্শে এসে আমরা আমাদের অধিকাংশ মনোভাব অর্জন করি।

সমাজ মনোবিজ্ঞানী বোনার (Bonner) এ বিষয়ে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে একটি উদাহরণ দিয়েছেন। একটি আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ পরিবারে পিতামাতা উভয়েই তাদের নিগ্রো ভৃত্যের প্রতি খুব সদয় মনোভাবাপন্ন ছিলেন।

তাদের দুটো শিশুসন্তানও নিগ্রো ভৃত্যটিকে খুব পছন্দ করতো। দু বছর পর তারা অন্য এক অঞ্চলে চলে যান। সেখানে নিগ্রো বিদ্বেষ প্রবল ছিল। দেখা গেল যে, অত্যল্প কালের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ শিশু দুটো নিগ্রো বিদ্বেষী হয়ে উঠলো।

Conclusion:

শিশুরা বর্ণবৈষম্য সম্পর্কে সচেতন হয়েও শ্বেতাঙ্গ শিশুরা যে সম্প্রদায়ভুক্ত সেই সম্প্রদায়ের সদস্যরা নিগ্রোদের সম্পর্কে নানা প্রতিকূল মন্তব্য করার ফলে নিগ্রোদের প্রতি প্রতিকূল মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়ে।
Last Line: মনোভাব কি ? মনোবিজ্ঞান (What is attitude? Psychology)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top