একটি শিশু জন্মগ্রহণের পর ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। শিশুটির বড় হওয়ার বিভিন্ন পর্যায়কে কাল হিসেবে ধরা হয়। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর শৈশবকাল। শৈশবকালে ছেলে বা মেয়ে সকলকে শিশু বলা হয়। ছয় থেকে দশ বছর পর্যন্ত বয়সকে আমরা বলি বাল্যকাল। বাল্যকালে শিশু মেয়ে হলে বালিকা এবং ছেলে হলে বালক বলা হয়।
দশ থেকে উনিশ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলে বা মেয়েকে কিশাের বা কিশােরী হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই সময়কে বয়ঃসন্ধিকাল বলে। এ সময়ে তাদের শরীর যথাক্রমে পুরুষের বা নারীর শরীরে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
বয়ঃসন্ধিকাল ও স্বাস্থ্য সচেতনতা (Adolescence Period and health awareness)
![]() |
বয়ঃসন্ধিকাল |
বয়ঃসন্ধিকাল ও বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন : (Adolescence Period and changes in puberty)
মানুষের জীবনে বয়সের ভিত্তিতে অনেকগুলাে পর্যায় আসে। যেমন-
- শৈশব,
- বাল্য,
- কৈশাের,
- যৌবন,
- প্রৌঢ়ত্ব ও
- বার্ধক্য।
শিশুর জন্ম থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শৈশবকাল, ছয় থেকে দশ বছর বাল্যকাল, দশ থেকে উনিশ বছর কৈশােরকাল বলা হয়। কৈশােরকালে একটি ছেলে বা মেয়েকে কিশাের বা কিশােরী বলা হয়।
কৈশােরকালে কিশাের বা কিশােরীরা শারীরিকভাবে পুরুষ বা নারীতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই কৈশােরকালকে বয়ঃসন্ধিকাল বলে।
ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল আগে শুরু হয়। মেয়েদের আট থেকে তেরাে বছর বয়সের মধ্যে বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হয়। ছেলেদের দশ থেকে পনেরাে বছর বয়সে বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হয়। কারাে কারাে ক্ষেত্রে এর আগে বা পরেও বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হতে পারে।
বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন (Changes During Adolescence Period )
বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনগুলাের মধ্যে দৈহিক বা শারীরিক পরিবর্তনগুলােই প্রথমে চোখে পড়ে। এই পরিবর্তন দেখলেই বােঝা যায় যে কারাে বয়ঃসন্ধিকাল চলছে। বয়ঃসন্ধিকালে যে সব পরিবর্তন দেখা দেয়, সেগুলাে প্রধানত ৩ প্রকার।
- ১. শারীরিক
- ২. মানসিক
- ৩, আচরণিক
বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক পরিবর্তন (Physical changes during Adolescence Period)
বয়ঃসন্ধিকালে কিশােরদের পরিবর্তণ (Boys change during Adolescence Period)
বয়ঃসন্ধিকালে কিশােরদের ক্ষেত্রে যে সব পরিবর্তন লক্ষ করা যায় তা হচ্ছে
- ক. উচ্চতা ও ওজন বাড়ে।
- খ. শরীরে দৃঢ়তা আসে, বুক ও কাঁধ চওড়া হয়।
- গ. এ বয়সে দাড়ি গোঁফ উঠে।
- ঘ. স্বরভঙ্গ হয় ও গলার স্বর মােটা হয়।
- ঙ. বীর্যপাত হয়।
বয়ঃসন্ধিকালে কিশােরীদের পরিবর্তণ (Changes in girls during Adolescence Period)
কিশােরীদের পরিবর্তনসমূহ নিম্নরূপ
- ক. উচ্চতা ও ওজন বাড়ে।
- খ. শরীর ভারী হয়, শরীরের বিভিন্ন হাড় মােটা ও দৃঢ় হয়।
- গ. ঋতুস্রাব শুরু হয়।
বয়ঃসন্ধিকালে সবার ক্ষেত্রে শারীরিক পরিবর্তনগুলাে একই সময়ে ও একই রকম নাও হতে পারে। যেমন কিশােরীদের ক্ষেত্রে কারাে আগে বা পরে ঋতুস্রাব শুরু হতে পারে। কিশাের কিশােরীদের ক্ষেত্রে সকলের উচ্চতা একইভাবে নাও বাড়তে পারে।
বয়ঃসন্ধিকালে মানসিক পরিবর্তন : (Mental changes during Adolescence Period)
- ক. অজানা বিষয়ে জানার কৌতূহল বাড়ে।
- খ. শারীরিক পরিবর্তনের ফলে চলাফেরায় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও লজ্জা কাজ করে।
- গ. স্বাধীনভাবে চলতে ইচ্ছা করে।
- ঘ. নিকটজনের মনােযােগ, যত্ন ও ভালােবাসা পাওয়ার ইচ্ছা তীব্র হয়।
- ঙ. আবেগ দ্বারা পরিচালিত হওয়ার প্রবণতা বাড়ে।
- চ. ছেলে ও মেয়েদের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে।
- ছ. মানসিক পরিপক্বতার পর্যায় শুরু হয়।
আচরণিক পরিবর্তন : (Behavioral changes during Adolescence Period)
- ক. প্রাপ্তবয়স্কদের মতাে আচরণ করে।
- খ. বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে নিজেকে একজন আলাদা ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
- গ. প্রত্যেক বিষয়ে নিজের মতামত প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে।
- ঘ. দুঃসাহসিক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়ে।
বয়ঃসন্ধিকালের মানসিক চাপ ও পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানাে : (Adapting to the stresses and changes of Adolescence Period)
আমরা পূর্বেই জেনেছি যে সাধারণত ছেলে-মেয়েদের ১০-১৯ বছর বয়সের সময় কালকে বয়ঃসন্ধিকাল বলে। এ সময়ে ছেলে-মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়। তবে আবহাওয়া, স্থান, খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ ও মানের তারতম্যের কারণে এক একজনের বয়ঃসন্ধিকালের শুরুর সময়ে কিছুটা তারতম্য হতে পারে।
হরমােন এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ যার কারণে বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনগুলাে ঘটে। মেয়েদের শরীরে ও মনে বিভিন্ন পরিবর্তনে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন নামে দুটি হরমোেন কাজ করে আর ছেলেদের যে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনসমূহ ঘটে তা টেস্টোস্টেরন নামক হরমােনের কারণে হয় ।
বয়ঃসন্ধিকালের মানসিক চাপ : The stress of (Adolescence Period)
ছেলে ও মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তনের কারণে মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়। কারণ পরিবর্তনগুলাে অনেকটা আকস্মিকভাবে শুরু হয়। এর সাথে পরিচিত না থাকার কারণে তারা আতংকিত হয়ে পড়ে এবং অপরাধবােধে ভােগে।
এ সময় তাদের বুঝিয়ে বললে তারা আতংকিত হবে না এবং তাদের মনে কোনাে অপরাধবােধ কাজ করবে না। এ ধরনের অপরাধবােধ ও মানসিক দুশ্চিন্তা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ফলে ছেলেমেয়েদের মনে সর্বক্ষণ একটা অস্বস্তি কাজ করে।
তারা মানসিক চাপের সম্মুখীন হয় এবং অনেক সময় পড়াশােনা ও অন্যান্য কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়।
বয়ঃসন্ধিকালের মানসিক পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানাে : (Adapting to the psychological changes of Adolescence Period)
বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনগুলাে সম্পর্কে জানা থাকলে এবং এ সন্বন্ধে করণীয় বিষয়ে পূর্ব ধারণা থাকলে, কিশাের-কিশােরীদের মানসিক প্রস্তুতি থাকে। ফলে তারা বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারে, তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয় না এবং সম্ভাব্য রােগব্যাধিও প্রতিরােধ করা যায়।
বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন ঘটলে – বাবা, বড় ভাই-বােন বা নির্ভরযােগ্য অভিভাবকদের সাথে আলােচনা করে এ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যেতে পারে। ফলে সংকোচ কেটে যাবে এবং একা থাকার প্রবণতা কমে যাবে।
বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তনের সাথে সাথে আবেগিক পরিবর্তনও ঘটে। এ বয়সে তাদের যে মানসিক পরিবর্তন ঘটে তার সাথে খাপ খাওয়ানাের জন্য তাদের সাথে মা বাবা ও অভিভাবকদের বন্ধুসুলভ ও সহানুভূতিশীল আচরণ করতে হবে।
তাদেরকে মানসিক দিকসহ অন্য সব ব্যাপারে সহযােগিতা প্রদান ও সাহস যােগাতে হবে। কিশাের-কিশােরীদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য তাদের নিজেদেরকেও সচেষ্ট থাকতে হবে। তাদের প্রথম কাজ হবে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলাের সাথে খাপ খাওয়ানাের চেষ্টা করা।
ভালাে গল্পের বই পড়লে, সাথীদের সাথে খেলাধুলা করলে মনে প্রফুল্লতা আসবে এবং মানসিক চাপ সামলানাে সম্ভব হবে।
বয়ঃসন্ধিকালে পুষ্টির প্রয়ােজনীয়তা : (Nutritional requirements during adolescence)
বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েদের দৈহিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়ােজন। সুস্থ দেহেই বাস করে সুন্দর মন। শরীর সুস্থ না থাকলে কোনাে কিছুতেই আনন্দ পাওয়া যায় না। লেখাপড়া করতেও ইচ্ছে করে না। সেজন্য খাদ্য ও পুষ্টির দরকার।
আবার যে কোনাে খাবার খেলেই যে শরীর ভালাে থাকবে তা নয়। কারণ সব ধরনের খাদ্যেই শরীরের জন্য প্রয়ােজনীয় সব ধরনের খাদ্য উপাদান থাকে না। সেজন্য খাদ্য নির্বাচনের সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন প্রতিদিনের খাবারে আমিষ, শর্করা, চর্বি বা তেল, খনিজ দ্রব্য, ভিটামিন ও পানি প্রয়ােজনীয় পরিমাণে পাওয়া যায়।
বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েদের পুষ্টির প্রয়ােজনীয়তা ও সুষম খাদ্য : (The nutritional needs and balanced diet of boys and girls during adolescence)
বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েদের পুষ্টির প্রয়ােজন খুব বেশি। কেননা এই সময়ে ছেলে-মেয়েরা হঠাৎ বেড়ে উঠে এবং তাদের শারীরিক ক্রিয়াকলাপ বৃদ্ধি পায়। সেজন্য তাদের প্রতিদিনই যথাযথ পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্য গ্রহণ করা প্রয়ােজন।
কিন্তু অনেক ছেলে-মেয়ে ও তাদের অভিভাবকেরা এ বিষয়ে গুরুত্ব দেন না। কেউ কেউ মনে করেন যে প্রয়ােজনীয় খাদ্য উপাদান ও পুষ্টি শুধুমাত্র দামি খাবার ও ফলমূলেই পাওয়া যায়। কিন্তু এ ধারণা ভুল।
একটু সচেতন হলেই সহজপ্রাপ্য ও সুলভমূল্যের খাদ্যদ্রব্য থেকে প্রয়ােজনীয় খাদ্য উপাদান পাওয়া যায়।
দুরারােগ্য নয় মস্তিষ্কের টিউমার (Brain tumors are not incurable)
বয়স, দৈহিক গঠন ও কাজের ধরনভেদে পুষ্টির প্রয়ােজনীয়তা : (Need for nutrition according to age, physical constitution and type of work)
৬টি খাদ্য উপাদানসমৃদ্ধ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন বিভিন্ন খাদ্যের প্রয়ােজনীয় পরিমাণের সমাহারকে সুষম খাদ্য বলে। বয়সভেদে এই “প্রয়ােজনীয় পরিমাণের তারতম্য হতে পারে।
যেমন ১৩/১৪ বছর বয়সের কোনাে কিশাের বা কিশােরীর পুষ্টির প্রয়ােজন একটি ৮/৯ বছরের শিশুর চেয়ে বেশি। একই বয়সের মেয়ে শিশু ও ছেলে শিশু, কিশাের-কিশােরী, তরুণ-তরুণীর পুষ্টির প্রয়ােজনে কোনাে তারতম্য নেই।
আবার দু’জন একই বয়সের তরুণ বা তরুণী একজন বেশ দীর্ঘকায় ও স্বাস্থ্যবান এবং অপরজন ছােটখাটো ও সাধারণ স্বাস্থ্যের হলে, দৈহিক গঠনের কারণে প্রথমজনের প্রয়ােজনীয় পুষ্টির তথা খাদ্যের পরিমাণ দ্বিতীয় জনের চেয়ে বেশি হবে।
দু’জন একই বয়সী ও একই রকম দৈহিক গঠনের পুরুষের মধ্যে যিনি বেশি দৈহিক পরিশ্রম করেন তার খাদ্যের প্রয়ােজন বেশি হতে পারে। দু’জন সমবয়সী এবং একই রকম দৈহিক গঠন সম্পন্ন মেয়ের ক্ষেত্রেও এটি প্রযােজ্য। এভাবে বয়স, দৈহিকগঠন ও কাজের ধরনভেদে পুষ্টির প্রয়ােজনীয়তার তারতম্য হয়।
Conclusion:
খাদ্যের ৬টি উপাদানের প্রত্যেকটিই বয়ঃসন্ধিকালের ছেলে-মেয়েদের দৈহিক বৃদ্ধি ও সুস্থতার জন্য খুব প্রয়ােজন। এগুলাে দেহে প্রয়ােজনীয় পুষ্টি যােগায়। অন্যথায় যথাযথ পুষ্টির অভাবে দৈহিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। এছাড়া প্রয়ােজনীয় পুষ্টির অভাবে ছেলেমেয়েরা নানা রকম রােগে আক্রান্ত হয়।
Last Line: বয়ঃসন্ধিকাল ও স্বাস্থ্য সচেতনতা (Adolescence Period and health awareness)