প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮)

প্রাচীন সভ্যতার উত্থান থেকে আধুনিক ইতিহাসের বিশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত অসংখ্য ভয়াবহ যুদ্ধের কথা আমাদের জানা আছে। তবে ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে সংঘটিত প্রথম মহাযুদ্ধের ব্যাপ্তি, ধ্বংসযজ্ঞ, হতাহতের সংখ্যা অতীতের সকল যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণকে অনেক গুণ অতিক্রম করে গেছে । ইতিহাসের পাতায় এই যুদ্ধকে বলা হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ  (WWI বা WW1) |

 প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮)

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮)


পটভূমি

১৯১৪-এর জুলাই মাসের ২৮ তারিখ থেকে অস্ট্রো-হাঙ্গেরি এবং সার্বিয়ার মধ্যে শুরু হয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপীয় প্রায় সকল দেশে। 

যুদ্ধের আগুন আটলান্টিকের ওপারের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এশিয়ার বেশ কিছু দেশেও বিস্তৃত হয়। এ কারণেই এ যুদ্ধকে বিশ্বযুদ্ধ বা মহাযুদ্ধ বলা হয়। 

আগে কখনও এমনটি হয় নি বলে এটিকেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। খুব বড় মাপের যুদ্ধ বলেই এটিকে মহাযুদ্ধ বলা হয়ে থাকে। দুটি শিবিরে বিভক্ত সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা থেকেই প্রথম মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল । 

এটিকে শুধু বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে সার্ব আততায়ী কর্তৃক অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফ্রান্সিস ফার্দিনেন্দ এবং তাঁর স্ত্রী সোফিয়ার হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে দেখার কোনো কারণ নেই। 

এ মহাযুদ্ধের কারণ অনেক গভীরে প্রোথিত। শুধু শুধু এমনিতে এতগুলো দেশ একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে নি, এত মৃত্যু ও ধ্বংসকে কেউ বরণ করে নি। 

প্রথম মহাযুদ্ধের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের মধ্যেই এর প্রকৃত কারণ লুকিয়ে আছে। উপনিবেশবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের উত্থান ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলোকে নীতিবিবর্জিত বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে ফেলে। 

ক্রমে তা সামরিক শক্তি শিবিরে বিভক্ত করে এবং এর করুণ পরিণতির স্বরূপ তথা মহাযুদ্ধের বিভীষিকা বরণ করতে বাধ্য হলো সাধারণ মানুষকে। এ যুদ্ধের পেছনে অনেক ছোটখাটো ঘটনা জড়িত থাকলেও মৌলিক কিছু বিষয়ের মধ্যেই প্রথম মহাযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার কারণ নিহিত ছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বেশ কিছু অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে সংঘটিত হয়েছিল। সে কারণগুলো জানা প্রয়োজন।

অর্থনৈতিক কারণ : 

প্রথম মহাযুদ্ধের প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা। ইউরোপের আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে নিজ নিজ কলোনি বা উপনিবেশ স্থাপনের প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়। 

এই সব দেশের উৎপাদিত পণ্যের জন্যে বাজারের সম্প্রসারণ জরুরি হয়ে পড়ে। ফলে অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার জন্যে অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলো উপনিবেশ স্থাপনে নেমে পড়ে। এ নিয়ে উন্নত পুঁজিবাদী ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা ও দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। 

১৮৭১ সালের পর ঐক্যবদ্ধ জার্মান রাষ্ট্রের শিল্পোৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এসব পণ্য ব্রিটিশ ও ফরাসিদের নিয়ন্ত্রিত বাজারে প্রবেশ করানো বেশ কঠিন ছিল। সর্বত্র জার্মান পণ্য ব্রিটিশ পণ্যের বাধার সম্মুখীন হয়। 

জার্মানিতে হাম বুর্গ আমেরিকা এবং উত্তর জার্মান লয়েড’ কোম্পানি জাহাজ শিল্পে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। রেলপথ নির্মাণে জার্মানির একচেটিয়া পুঁজির প্রসার ঘটে। 

১৮৮৮ সালে শুরু হওয়া কনস্তান্তিনোপল থেকে বাগদাদ এবং পারস্য উপসাগর পর্যন্ত সুদীর্ঘ রেলপথ নির্মাণের কাজ ১৯০৩ সালে শেষ হয়। (১)

উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুতে আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় গোটা অংশই ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, ইতালি, পর্তুগাল এবং নেদারল্যান্ডের করতলগত হয়। 

ইউরোপের ভূখণ্ডে ফ্রান্সের বাজার একচেটিয়া জার্মানির হাতে চলে যেতে থাকে। ১৮৭০ সালে ফ্রান্স ও প্রুশিয়ার (জার্মানির একটি অংশ) মধ্যে যুদ্ধে আলসেস ও লরেন হারানোর ফলে ফ্রান্সের কয়লা সম্পদ কমে যায় , জার্মানি তা ব্যবহার করে কয়লা রপ্তানি ও শিল্পোৎপাদনে এগিয়ে যায়। 

অনুন্নত দেশ হলেও তুর্কি সাম্রাজ্যের দিকে রাশিয়ার দৃষ্টি ছিল গভীরভাবে নিবদ্ধ। একইভাবে স্লাভ অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহেও তার প্রভাব বিস্তার লাভের যথেষ্ট কারণ ছিল। রাশিয়ার জন্যে অস্ট্রিয়া ছিল শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। 

গ্রিস, রুমানিয়া, সার্বিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে অস্ট্রিয়ার প্রভাব বিস্তার রাশিয়ার পক্ষে মেনে নেওয়া বেশ কঠিন ছিল। এক সময় অস্ট্রিয়ার প্রতিপক্ষ হিসেবে জার্মানি থাকলেও নতুন পরিস্থিতিতে এসে অস্ট্রিয়া জার্মানিকে বন্ধুর আসনে বসাতে দ্বিধা করে নি। 

জার্মানির চতুর্দিক পরিবেষ্টিত অবস্থায় অস্ট্রিয়াকে তার অস্ত্রের খুঁটি হিসেবে পেয়ে যারপরনাই লাভবান হয়েছিল। এভাবেই ইউরোপে সাম্রাজ্যবাদের উত্থান পুঁজিবাদী দেশগুলোকে পরস্পরের প্রতিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেয়। 

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপনিবেশ বিস্তার, বাজার দখল ইত্যাদি নিয়ে একটি বড় ধরনের দ্বন্দ্ব তথা যুদ্ধের দিকে সব কটি দেশই ধাবিত হতে থাকে।

রাজনৈতিক কারণ

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতা 

উনিশ শতকে পুঁজিবাদের বিকাশ যতখানি হয়েছিল, তার সঙ্গে সংগতি রেখে গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থার প্রয়োগ, চর্চা এবং নিয়ম-নীতি অনুসরণের সংস্কৃতি ইউরোপের অধিকাংশ দেশে বলতে গেলে চালুই হয় নি। 

ইংল্যান্ড এককভাবে এ ক্ষেত্রে অগ্রসর দেশ হলেও ইংল্যান্ডের একচেটিয়া পুজিপতি গোষ্ঠী বিশ্ব ভাগাভাগিতে পিছিয়ে থাকতে চায় নি। দীর্ঘ সময় ধরে ইউরোপের সব দেশেই স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। 

উনিশ শতকে বেশ কিছু বিপ্লব, আন্দোলন, সংগ্রাম হলেও রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা কোথাও তেমন চালু হয় নি। 

সামন্তরাজতন্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ দখল, সম্পদ লুণ্ঠন, প্রভাব বিস্তার ইত্যাদি আচরণে অভ্যস্ত ছিল। উনিশ শতকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি সমর্থনপুষ্ট সরকারগুলোও পূর্ববর্তী রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হতে পারে নি। 

ফলে ইউরোপের অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলো যুদ্ধের পরিকল্পনা থেকে সামরিক জোট গঠন এবং ছোট বড় ও স্থানীয় পর্যায়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। 

মরক্কো সংকটে (১৯০৫-১৯০৬, ১৯১১) ইতালি-তুরস্কের যুদ্ধ (১৯১১-১৯১২), বলকান যুদ্ধ (১৯১২-১৯১৩) ইত্যাদি ঘটনায় এসব দেশ এমনিভাবে জড়িয়ে পড়ে যে, তা থেকে শেষ পর্যন্ত বের হওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এভাবেই ইউরোপীয় শক্তিসমূহ এমন এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, যা শেষ পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে একটি মহাযুদ্ধে পরিণত হয়। (২) () ()

রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার অভাব, সংকট এবং যুদ্ধের উগ্র মনোবৃত্তি মূলত বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি থেকেই জন্ম নিয়েছিল।

জাতীয়তাবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান : 

১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে যে বিপ্লব সংঘটিত হয় তা ইউরোপে জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটাতে সাহায্য করে। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ফরাসি বিপ্লবকে ইউরোপে ছড়িয়ে দিতে একের ও এক সমরাভিযানে নেতৃত্ব দেন। ()

তখন পর্যন্ত বেশির ভাগ দেশেই রাজতন্ত্র এবং বড় বড় দেশের কর্তৃত্ব একচেটিয়া ছিল। নেপোলিয়নের অভিযানের ফলে ইউরোপে সমান্তবাদ ও রাজতান্ত্রিক পরদেশী শাসনের যাঁতাকল ভাঙার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়। 

এরই পথ ধরে উনিশ শতকের সত্তর দশকের মধ্যে ইউরোপের ইতালি, জার্মানি, গ্রিস, সার্বিয়া, নিয়া ও বুলগেরিয়ার মতো স্বাধীন দেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। জাতীয়তাবাদ ইউরোপের মানুষের মনোজগতে ঐক্যের আবহ তৈরি করে। 

অনেকগুলো সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। মধ্য ইউরোপ এবং বলকান অঞ্চলে এ নিয়ে আধিপত্য বিস্তার, সংঘাত, সমরবাদের নানা ষড়যন্ত্র হয়। এ থেকে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। 

অন্য জাতির স্বাধীনতা ও অধিকারকে স্বীকার না করে নিজস্ব রাষ্ট্র ও জাতির শ্রেষ্ঠত্বকে যে মতবাদ প্রকাশ করে তাই উগ্র জাতীয়তাবাদ। নিজ জাতির মতো অন্য দেশ এবং জাতির অধিকারকে মর্যাদা প্রদান করে জাতীয়তাবাদ। 

কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদ তা করে না। ইউরোপে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গোষ্ঠী উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুতে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে থাকে। এ থেকেই ইউরোপ ভয়াবহ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সংঘাতের দিকে প্রবেশ করে।

ত্রিশক্তি চুক্তি বা মৈত্রী

() ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে সেডানের যুদ্ধে ফ্রান্সকে পরাজিত করে জার্মান চ্যান্সেলর বিসমার্ক জার্মানি ঐক্য সম্পন্ন করেন। এরপর ইউরোপে ফ্রান্সকে মিত্রহীন করে রাখার জন্যে জার্মানি অস্ট্রিয়ার সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে। 

সে সময় রাশিয়া হিল শক্তিশালী বৃহৎরাষ্ট্র। ফ্রান্স যাতে রাশিয়ার সাথে মিত্রতাবদ্ধ হতে না পারে সেজন্য জার্মানি চ্যান্সেলর বিসমার্ক পুলিশ বিদ্রোহ দমনে রাশিয়াকে সহায়তা করে। 

এর ফলে রাশিয়া জার্মানির প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হয়। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে বার্লিনে এক সম্মেলন আহ্বান করে জার্মানি রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই সম্মেলনে জার্মানির সম্রাট প্রথম উইলিয়াম, রাশিয়ার জার, প্রথম আলেকজান্ডার এবং অস্ট্রিয়ার সম্রাট প্রথম ফ্রান্সিস উপস্থিত ছিলেন। 

এই তিন সম্রাটের চুক্তিকে ইতিহাসে ত্রিশক্তি চুক্তি বা ত্রি-সম্রাটের মৈত্রী হিসেবে অভিহিত করে। ত্রিশক্তির মধ্যে মিত্ৰতা সম্প্রীতি ও সদ্ভাব রক্ষা করা এই চুক্তির লক্ষ্য ছিল। 

কিন্তু ১৮৭৭-৭৮ খ্রিস্টাব্দে রুশ-তুরস্ক যুদ্ধে এই মৈত্রীর কার্যকারিতা লক্ষ্য না করে রাশিয়া ত্রিশক্তি চুক্তি ত্যাগ করে। ()

এ অবস্থায় জার্মানি দ্রুত অস্ট্রিয়ার সাথে দ্বি-শক্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে এই সন্ধি দ্বারা স্থির হয় যে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে কোন একটি আক্রান্ত হলে অপর রাষ্ট্র তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে। 

এভাবে সামরিক বিষয় চুক্তির মধ্যে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। চুক্তিতে স্থির হয় যে রাশিয়া যদি অস্ট্রিয়া আক্রমণ করে তাহলে জার্মানি অস্ট্রিয়ার পাশে দাঁড়াবে। 

অস্ট্র-হাঙ্গেরী এবং জার্মানির এই মিত্ৰতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। বিসমার্ক দ্বিশক্তি চুক্তি ১৮৭৯ খ্রি. জোটকে অচিরেই ত্রি-শক্তি জোটে পরিণত করেন। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স তিউনিস আক্রমণ করলে ইতালি ক্ষুব্ধ হয়। 

বিসমার্ক বিক্ষুব্ধ ইতালিকে দ্বি-শক্তি জোটের সাথে অন্তর্ভুক্ত করেন। ফলে দ্বি-শক্তি জোট ত্রি-শক্তি জোটে রূপান্তরিত হয়।

১৮৮২ সালে অস্ট্র-হাঙ্গেরী, জার্মানি এবং ইতালির মধ্যে ত্রি-শক্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যা ইতিহাসে ত্রিশক্তি চুক্তি (Triple Alliance) নামে পরিচিত। 

এটি মূলত ফ্রান্স ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে চুক্তির শর্তে এগিয়ে চলার দৃঢ় পদক্ষেপ। ত্রিশক্তি চুক্তিতে উল্লেখ ছিল যে বিনা প্ররোচনায় ফ্রান্স ইতালিকে আক্রমণ করলে অন্য দুটি মিত্রের যেকোন একটি বা দুটি রাষ্ট্রই ইতালিকে সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসবে। 

অনুরূপভাবে ইতালি ও অন্যদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। ফ্রান্স জার্মানি আক্রমণ করলে ইতালি জার্মানির সাহায্যে এগিয়ে আসবে। তবে সন্ধিতে বলা হয় যে, এই সন্ধি ব্রিটেনের বিরুদ্ধে কার্যকর হবে না। 

এ সন্ধি জার্মানি ও ইতালিকে অধিকতর নিরাপত্তা প্রদান করলেও অস্ট্র-হাঙ্গেরী স্বার্থ সেভাবে বিবেচনা করা হয়নি।

ত্রিশক্তি আঁতাত

ত্রিশক্তি চুক্তি ইউরোপে জার্মানির প্রভাব বৃদ্ধি করে। ইংল্যান্ড এ সময় আফ্রিকায় উপনিবেশ বিস্তারে ব্যস্ত থাকায় ইউরোপের রাজনীতিতে মাথা ঘামায়নি। ()


কিন্তু সাম্রাজ্য বিস্তারে ইউরোপীয় অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে ইংল্যান্ডের প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। ইংল্যান্ড ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার সাথে রি-ইনসিউরেন্স চুক্তি করে কোন শক্তি কর্তৃক জার্মানি আক্রান্ত হলে রাশিয়াকে নিরপেক্ষ রাখতে সক্ষম হয়। 

এটি ছিল ফ্রান্সকে ইউরোপে মিত্রহীন করে রাখা। ইতোমধ্যে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স বিমসার্কের ক্ষমতাচ্যুতি হলে জার্মান পররাষ্ট্র নীতির পট পরিবর্তন হয়। 

জার্মানি বলকান অঞ্চলে অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্য বিস্তার নীতিকে সমর্থন করলে রাশিয়ার সাথে জার্মানির মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়। জার্মানি বাগদাদের সাথে রেল যোগাযোগ স্থাপন করে তুরস্কের উপর প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হয়। যা ছিল রাশিয়ার স্বার্থের পরিপন্থী। 

এ কারণে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া ফ্রান্সের সাথে দ্বি-শক্তি মৈত্রী স্থাপন করে। ইংল্যান্ড প্রথমে ফ্রান্স ও রাশিয়ার এই মিশ্রনীতিকে ভাল চোখে দেখেনি। ইংল্যান্ড নিজস্বার্থে জার্মানির সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষপাতী ছিল। 

কিন্তু জার্মানি ইংল্যান্ডের মিত্রতাকে গুরুত্ব না দিয়ে উপনিবেশ প্রশ্নে ইংল্যান্ডের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়। এ অবস্থায় ইংল্যান্ড জার্মানির ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে প্রতিরোধ করার জন্যে ফ্রান্সের সাথে তাঁর মতবিরোধ কমিয়ে বন্ধুত্ব স্থাপনের পদক্ষেপ নেয়। 

এর প্রেক্ষিতে ১৯০৪ খ্রি. ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে আঁতাত বা মিত্রতা স্থাপিত হয়। () মুলত আফ্রিকায় সাম্রাজ্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ মিত্রচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। 

১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের পর জার্মানির সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা লক্ষ্য করে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী ইজভলস্কি ইংল্যান্ডের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের পদক্ষেপ নেয়। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে রুশ-জাপান যুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত হলে এশিয়ায় রুশ আধিপত্য দুর্বল হয়ে পড়ে। 

ইংল্যান্ডের উপনিবেশ- ভারতের সীমান্তে আফগানিস্তানের রুশ প্রভাব বা সাম্রাজ্য বিস্তারের অগ্রগতি আহত হওয়ায় ইংল্যান্ড ও রাশিয়ার মধ্যে স্বার্থ-সংঘাতের ক্ষেত্র ছিল না। এর প্রেক্ষিতেই ইংল্যান্ড ও রাশিয়ার মধ্যে আঁতাত সৃষ্টি হয়। 

এ পর্যায়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়ার মিত্রতা ত্রিশক্তি আঁতাতে (Triple entente) পরিণত হয়। এর হলে ইউরোপ দুটো পরস্পর বিরোধী সামরিক জোটে বিভক্ত হয়ে পড়ে। 

জার্মানি, ইতালি ও অস্ট্র-হাঙ্গেরীর ত্রি শক্তি বা মৈত্রী ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়ার ত্রিশক্তি আঁতাতের প্রতিপক্ষ হয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রভাব বৃদ্ধির ক্ষেপ নেয়। 

এ দুটি পরস্পর বিরোধী সামরিক জোট যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নামে অভিহিত হয়।বিত রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে ইউরোপে বড় ধরনের যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করে ছিল। 

শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের হবে জোটবদ্ধ হওয়ায় কারও পক্ষে এককভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া সম্ভব ছিল না। এ জন্যে মিত্রশক্তিগুলো সামরিক গঠন করেছিল। 

১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে বিসমার্ক জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য জোট রাজনীতির কৌশল গ্রহণ করছিলেন। যা ফ্রান্সের জন্য নিরাপত্তা সংকট তৈরি করেছিল। 

সে জন্যে ফ্রান্স নিজ স্বার্থে ইংল্যান্ড ও রাশিয়ার সাথে জোটবদ্ধ কূটনীতির কৌশল গ্রহণ করে। ফলে ইউরোপ পরস্পর বিরোধী দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পরের অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।

তথ্যসুত্রঃ 

১. https://en.wikipedia.org/wiki/Berlin%E2%80%93Baghdad_railway
২. https://www.britannica.com/event/Moroccan-crises
৩. https://www.britannica.com/event/Italo-Turkish-War
৪. https://encyclopedia.1914-1918-online.net/article/balkan_wars_1912-1913
৫. https://www.history.com/topics/france/french-revolution
৬. https://www.albanycounty.com/home/showpublisheddocument/7414/636994871520970000
৭. https://en.wikipedia.org/wiki/William_I,_German_Emperor#:~:text=William%20I%20or%20Wilhelm%20I,state%20of%20a%20united%20Germany.
৮. https://en.wikipedia.org/wiki/Nicholas_II_of_Russia
৯. http://www.saint-petersburg.com/royal-family/alexander-i/
১০. https://www.britannica.com/biography/Franz-Joseph#:~:text=Franz%20Joseph%20was%20the%20emperor,Germany%20into%20World%20War%20I.
১১. https://www.britannica.com/topic/Tripartite-Pact
১২. https://www.britannica.com/event/Reinsurance-Treaty#:~:text=Reinsurance%20Treaty%2C%20(June%2018%2C,spheres%20of%20influence%20in%20the
১৩. https://www.history.com/this-day-in-history/britain-and-france-sign-entente-cordiale#:~:text=On%20April%208%2C%201904%2C%20with,understanding%20between%20the%20two%20countries.
১৪. https://www.oxfordreference.com/view/10.1093/oi/authority.20110803105745646
১৬. https://www.history.com/this-day-in-history/archduke-ferdinand-assassinated
১৭. https://www.britannica.com/event/Schlieffen-Plan#:~:text=Schlieffen%20Plan%2C%20battle%20plan%20first,a%20successful%20two%2Dfront%20war.&text=Germany%2C%20therefore%2C%20could%20eliminate%20one,other%20was%20kept%20in%20check.
১৮. https://www.historynet.com/french-resistance-resistant.htm

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top