প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা খুব পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হয় নি। যুদ্ধটি প্রথম দিকে বিশ্বব্যাপীও ছিল না, বরং স্থানিকভাবেই যেন আগুন জ্বলে ওঠে, ক্রমে যুদ্ধের আগুন অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
আপনি এই প্রতিবেদনে নতুন হলে ১ম অংশ দেখুন… প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং যুদ্ধের কারণ (১৯১৪-১৯১৮)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ | ঘটনাপ্রবাহ
 |
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ | ঘটনাপ্রবাহ |
তিনটি মহাদেশের মোট ৩৪টি দেশ এই মহাযুদ্ধে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধ শুরুর আশু কারণ হিসেবে সবাই বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোয় অস্ট্রীয় যুবরাজ ফ্রান্সিস ফার্দিনান্দের হত্যাকাণ্ডকে ধরে থাকেন। (১)
আসলে বলকান অঞ্চল নিয়ে সৃষ্ট হতদ্বন্দ্বিতায় অস্ট্রিয়া, বুলগেরিয়া এবং রাশিয়া সার্বিয়ার পক্ষালম্বন করে। এর ফলে সার্বিয়াতে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। সার্বিয়া তখন ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা নিয়ে একটি সংযুক্ত সার্ব রাষ্ট্র স্থাপন করতে চাচ্ছিল।
অস্ট্রিয়া, সার্বিয়ার এ পরিকল্পনার বিরোধী ছিল। এমনিতেই ১৯১৪ সালে ইউরোপের পরিস্থিতি পারস্পরিক অশ্রদ্ধায়, উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
অস্ট্রিয়া কর্তৃক সার্ব বাহিনী পশ্চিমে বধাপ্রাপ্ত হয়ে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রচারণায় নেমে পড়ে। এ ধরনের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের পরিবেশেই অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফ্রান্সিস ফার্দিনান্দ এবং তাঁর স্ত্রী সোফিয়া বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে বেড়াতে যান।
২৮ জুন সকাল ১১ টায় প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথেই সার্ব আততায়ী গ্যাবরিয়েল প্রিন্সেপের গুলিতে তাঁরা দুজন নিহত হন। (২)
এ হত্যাকাণ্ডের সাথে গুপ্ত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন Black hand জড়িত ছিল। অবশ্য ১৯১১ সাল থেকে Unity of Death নামে চরমপন্থি জাতীয়তাবাদী একটি দল অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল।
এ সংগঠনটি সৈন্যবাহিনীসহ সর্বত্র এর শাখা-সংগঠন এমনভাবে গড়ে তোলে যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদস্থ লোকও উক্ত গুপ্ত সমিতির সদস্য ছিলেন।
 |
যুবরাজ ফ্রান্সিস ফার্দিনান্দ এবং রানি সোফিয়া |
গুপ্ত সমিতি আর্ক ডিউককে হত্যা করে অস্ট্রিয়াকে প্রতিহত এবং সার্বিয়ার স্বার্থকে রক্ষা করতে চেয়েছিল। হত্যাকাণ্ডটি অস্ট্রিয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
সেখানেও উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী সার্বিয়াকে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করে। অস্ট্রিয়া সার্বিয়াকে চরমপত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯১৪ সালের ২৩ জুলাই তারিখে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জবাব চেয়ে অস্ট্রিয়া সার্বিয়ার কাছে উক্ত চরমপত্রটি প্রেরণ করে। চরমপত্রে দাবি করা ছিল,
- সার্বিয়াকে সকল প্রকার প্যানস্লাভ প্রচারণা বন্ধ এবং এর সঙ্গে জড়িত অফিসারদের বরখাস্ত করতে হবে,
- সকল গোপন সমিতি বন্ধ করতে হবে- এ কাজে অস্ট্রিয়ার সাহায্য নিতে হবে এবং
- অস্ট্রিয়ার যুবরাজের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কাজে সার্বিয়ায়। অস্ট্রীয় অফিসারদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
২৪ তারিখ যখন অস্ট্রো-হাঙ্গেরির রাষ্ট্রদূতগণ এ খবর বড় বড় দেশগুখেলাকে জানায় তখন তারা বিস্মিত হয়ে পড়েন। বোঝা যাচ্ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরি একটা কিছু করতে যাচ্ছে।
রাশিয়া এতে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিকে সাবধান করে দিয়েছিল। সার্বিয়া নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রত্যুত্তর প্রদান করে। বিষয়গুলো মধ্যস্থতার জন্য অস্ট্রিয়া হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালতের সাহায্য নিলে সার্বিয়ার কোনো আপত্তি থাকবে না বলে সার্বিয়া জানায়।
একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয় লঙ্ঘন করার দাবি যে অন্যায় সে সম্পর্কেও সার্বিয়া পত্রে উল্লেখ করে। স্বভাবতই অস্ট্রো-হাঙ্গেরিকে সার্বিয়ার বক্তব্য সন্তুষ্ট করে নি।
অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সার্বিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। তবে যুদ্ধের কোনো ঘোষণা তখনও তারা দেয় নি। ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালি মধ্যস্থতার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। জার্মানি আদৌ শান্তি স্থাপনের জন্য উদ্যোগে অংশ নিয়েছিল কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
মনে করা হয়ে থাকে যে, জার্মান বিদেশ দফতর অস্ট্রিয়ার কাছ থেকে যুদ্ধ ঘোষণার কথাটিই আদায় করতে প্ররোচিত করেছিল। জার্মানির সমর্থন পেয়েই অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে ২৮ জুলাই ১৯১৪ সালে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
জার্মানিও হয়তো ভাবতে পারেনি অস্ট্রো-হাঙ্গেরি বনাম বয়ার যুদ্ধই এভাবে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়বে, স্থানিক বা আঞ্চলিক এই যুদ্ধটিই মহাযুদ্ধে পরিণত হবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মানচিত্র
অনেকেরই ধারণা ছিল যে এটি একটি সীমিত যুদ্ধ হবে। জার্মান জেনারেলগণ এই যুদ্ধকে প্রথম থেকেই রাজনৈতিকভাবে মীমাংসার যে কোনো উদ্যোগ অগ্রাহ্যকর করে তোলেন। তারা সামরিকভাবেই এর ফয়সালায় যেতে ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে থাকেন।
জার্মান জেনারেল স্লিফেনের পরিকল্পনা (Schlieffen’s plan) মোতাবেক পূর্ব ও পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ করার পথে জার্মানি অগ্রসর হলো। ফলে পূর্ব ফ্রন্টের দেশ রাশিয়া এবং পশ্চিম ফ্রন্টের দেশ ফ্রান্সকে যুদ্ধ শুরু করতে বাধ্য করার কৌশল অবলম্বন করা হলো।
অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সার্বিয়া আক্রমণ করলে রাশিয়া তার পশ্চিম সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। জার্মানি ১৯১৪ সালের ৩১ জুলাই ১২ ঘণ্টার মধ্যে রাশিয়াকে সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার আদেশ দানের মাধ্যমে যে চরমপত্র প্রদান করে রাশিয়া তার কোনো উত্তর দেয় নি।
ফলে ১ আগস্ট জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করে বসে এবং একইভাবে আগস্টের ৩ তারিখ ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। জার্মানি বেলজিয়ামের নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করায় ব্রিটেন ৪ তারিখ জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
২ তারিখেই তুরস্কের সরকার জার্মানির সঙ্গে গোপনে আঁতাত করে এবং জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণের ঘোষণাও প্রদান করে। শুরু হয় প্রথম মহাযুদ্ধ ।
বুলগেরিয়া, গ্রিস, স্পেন, পর্তুগাল, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং লাতিন আমেরিকার কিছু কিছু দেশ নিজেদের নিরপেক্ষ অবস্থানের কথা ঘোষণা দিতে তাড়াহুড়া করে।
একইভাবে জার্মান মৈত্রী জোটের দেশ ইতালি ও রুমানিয়াও নিজেদেরকে নিরপেক্ষ দেশ বলে ঘোষণা করে। কিন্তু এই যুদ্ধই বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিলে কেউ আর নিরপেক্ষ থাকতে পারে নি। অচিরেই তা সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
জল এবং স্থল পথে তা সম্প্রসারিত হতে থাকে। জার্মানি বেলজিয়াম দখল করায় ইংল্যান্ড যুদ্ধে যোগদান করতে বাধ্য হয়। জার্মান সেনাদল রাইন নদী অতিক্রম করে ফ্রান্সে ঢুকে পড়ে। ফরাসি বাহিনী জেনারেল জোসেফের নেতৃত্বে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
ব্রিটিশ বাহিনী ফরাসি বাহিনীর সঙ্গে যোগদান করে। সোম নামক স্থানে উভয় পক্ষের যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
 |
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মানচিত্র |
এই অবস্থায় ইতালি জার্মান-অস্ট্রো-হাঙ্গেরি মিত্র পক্ষ ত্যাগ করার গোষণা দিলে অস্ট্রো-হাঙ্গেরি ইতালি আক্রমণ করে। ইউরোপের পশ্চিমের এ যুদ্ধকে পশ্চিম রণাঙ্গনের যুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়।
পশ্চিম রণাঙ্গনের যুদ্ধ বেশ কিছু সময় ধরে অনিশ্চিয়তার মধ্য দিয়ে চলে। কোনো পক্ষই সুনিশ্চিত জয় ধরে রাখতে পারে নি। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব রনাঙ্গনেও।
সেখানে আঁতাত পক্ষের প্রধান শক্তি ছিল রুশ বাহিনী। রুশরা জার্মান ভূখণ্ড গ্যালিসিয়ায় প্রবেশ করলে জন সেনা কর্মকর্তা লডেনডফ তাদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। রুশরা ট্যানেনবার্গ এবং অগাস্টোভের যুদ্ধে বেশকতির সম্মুখীন হয়।
১৯১৫ সালে জার্মান দুর্ধর্ষ সেনাপতি হিন্ডনবার্গ রাশিয়ার ইউক্রেন এবং ক্রিমিয়া দখল করতে সক্ষম হন। জার্মানদের মিত্র দেশ তুরস্ক দার্দানালিস প্রণালি বন্ধ করে দেয়। এতে মধ্যপ্রাচ্যে প্রবেশে মিত্রবাহিনী বড় ধরনের সমস্যায় পড়ে।
তারপরও ব্রিটিশ বাহিনী বাগদাদ দখল করে নিতে সক্ষম হয়। তবে জার্মানির হাতে উন্নতমেরিন থাকায় সমুদ্র যুদ্ধে মিত্রবাহিনী বড়ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সমুদ্র তলদেশে ব্রিটিশ ও ফরাসি বেশ জাহাজ জার্মান গুপ্ত আক্রমণে হারিয়ে যায়।
অবশ্য অচিরেই ব্রিটিশরা নৌযুদ্ধে সাফল্য অর্জন করতে থাকে। ডগার ব্যাংক ও হ্যাগিলেন্ডের যুদ্ধে জার্মান বাহিনীকে ইংরেজ নৌশক্তি শক্তভাবে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। এতে উভয় পক্ষের বিপুল ক্ষতি হয়। এরপর থেকে জার্মান নৌশক্তি ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্মুখ নৌযুদ্ধ এড়িয়ে চলতে থাকে।
১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব হলে রাশিয়া বিশ্বযুদ্ধ থেকে বের হয়ে আসে। জার্মানি তখন পূর্ব রণাঙ্গনের শমা বেশ ত্যাগ করে পশ্চিম রাণাঙ্গনে সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। জার্মানি পুনরায় বেলজিয়াম এবং ফ্রান্স আক্রমণ করে।
এমতাবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির বিরুদ্ধে মিত্রপক্ষের সঙ্গে যোগদানের ঘোষণা দেয়। তাতেই যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। অন্য দিকে এশিয়ার দেশ জাপানও জার্মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করে। ফলে জার্মানি আর বিশ্বযুদ্ধে আপন শক্তিতে দাঁড়াতে পারছিল না।
দীর্ঘদিনের রণক্লান্তি আরো বেড়ে যায়। তাদের মনোবলও ভেঙে যায়। একের পর এক স্থল ও নৌযুদ্ধে জার্মান বাহিনী পরাজিত হতে থাকে। জার্মান নৌবাহিনীর অভ্যন্তরেই বিদ্রোহ দেখা দেয়। তারা জার্মানিতে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন জানাতে থাকে।
পরিস্থিতি দেখে জার্মান সম্রাট (কাইজার) দ্বিতীয় উইলিয়াম দেশ ত্যাগ করেন। জার্মানিতে একটি প্রজাতান্ত্রিক সরকার গঠিত হয়। ১৯১৮ সালে মহাযুদ্ধের দামামা বন্ধ হয়ে যায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্র শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ বিরতির চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল
প্রকৃতপক্ষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং সাধারণ মানুষের জীবনে চরম দুর্ভোগ বহন করে এনেছিল। এই যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর একচেটিয়া মালিকদের রমরমা অবস্থা তৈরি করে।
তবে এই যুদ্ধ মানুষকে ক্রমশই পুঁজিবাদী সমাজের অলীক স্বপ্ন থেকে মুক্ত হতে সুযোগ করে দেয়। রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জীবনে ব্যাপক হতাশার প্রভাব পড়ে।
এতে কেউ কেউ সমাজ সম্পর্কে গভীরভাবে বুঝতে শুরু করেন, কেউ বা উগ্র ভাবধারায় নিজেদের বিলিয়ে দেন। ইউরোপে এই যুদ্ধই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে বলে অনেকেই মনে করে থাকেন।১৯১৯ সালের ১৮ জানুয়ারি ফ্রান্সের প্যারি নগরীতে ৩২ টি দেশের এক হাজারেরও বেশি প্রতিনিধি নিয়ে একটি সম্মেলন শুরু হয়।
এই সম্মেলনে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইতালি পৃথিবীর ভাগ্যবিধাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই সম্মেলন দুনিয়াকে ভাগ-বাটোয়ারা করার ক্ষেত্রে অবদান রাখে।
জার্মানি ২৮ জুন ভার্সাই নগরীতে বিজিত দেশ হিসেবে চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়।
ফ্রান্স, ডেনমার্ক ও পোল্যান্ড-যার যার প্রাপ্য আদায় করে নেয়। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, আফ্রিকা মহাদেশ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জার্মান উপনিবেশগুলো ভাগ করে নিয়ে যায়।
অধিকন্তু জার্মানির কাছ থেকে ১৩২ বিলিয়ন স্বর্ণমুদ্রার মধ্যে ফ্রান্স (৫২%), ইংল্যান্ড (২২%), ইতালি (১০%)। বাকি অংশ অন্যান্য দেশ ভাগ করে নেয়। জার্মানি নিজের সামরিক বাহিনী গঠনের অধিকার হারায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চূড়ান্ত ফলাফল যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোনো রাষ্ট্রের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে নি। আক্ষরিক অর্থে পৃথিবীর ইতিহাস চর্চায় জার্মানিকে পরাজিত দেশ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
কেননা, জার্মানির সরকার যুদ্ধ শেষে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ঘোষণা দিয়েছিল। ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বরের পর জার্মানি সম্পূর্ণরূপে পরাজিত দেশ হিসেবেই ধিকৃত হয়েছিল।
ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আঁতাত পক্ষের দেশগুলো বিজয়ের আনন্দ করেছিল। তবে এই যুদ্ধের ফলে ইউরোপের সব দেশই ধ্বংসযজ্ঞের ওপর দাঁড়িয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে।
চারদিকে ছাইভস্ম, পোড়ামাটি, ক্ষত-বিক্ষত শহর, কলকারখানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ঘরে ঘরে স্বজন হারানোর বেদনায় ইউরোপের বাতাসে তখন আর্তনাদের চিৎকার আর কান্না ভেসে বেড়ায়।
৩৪ টি দেশের এক বিলিয়নেরও বেশি মানুষ যুদ্ধের বিভীষিকায় চার বছর জীবন-যাপন করেছিল। ৭ কোটি মানুষকে সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে অংশ নিতে হয়েছিল যুদ্ধে। এক কোটি মানুষ নিহত, ২ কোটির অধিক আহত হয়।
ইউরোপের আগের দু’শ বছরের বিভিন্ন যুদ্ধেও এত সংখ্যক মানুষ হতাহত হয় নি। মহাযুদ্ধে জার্মানি একাই হারিয়েছিল ২০ লাখ নাগরিককে, ৪০ লাখের অধিক সৈনিক আহত এবং ১০ লাখ বন্দী হয়েছিল। এই যুদ্ধে হাজার হাজার কলকারখানা ধ্বংস হয়।
বেকারত্ব, মহামারী, দুর্ভিক্ষ আর বিনা চিকিৎসায় কত মানুষ মারা যায় এর কোনো হিসাব নেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ইংল্যান্ড ছিল বিশ্বের প্রথম শিল্পোন্নত দেশ। যুদ্ধ এই দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়। শিল্প উৎপাদন ২০ শতাংশ কমে যায়।
জাতীয় সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ হারায় ব্রিটেন। ব্রিটেনে বৃদ্ধি পেয়েছিল শুধুমাত্র সামরিক অস্ত্রশস্ত্রের উৎপাদন, অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের আগে ব্রিটেনের কাছে ঋণগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিচিত থাকলেও যুদ্ধের সময় সামরিক অস্ত্রশস্ত্র উৎপাদন, যুদ্ধরত দেশগুলোর নিকট অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের দ্বারা যুদ্ধের পর পরই পৃথিবীর প্রধান ধনী দেশে পরিণত হয়।
ইংল্যান্ডের কাছেই ১৯১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্য দাঁড়ায় ৮৫০ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরই অর্থের বাজার লন্ডন সিটি থেকে নিউইয়র্ক সিটির ওয়ার্ল স্ট্রিটে স্থানান্তরিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্রিটেনের বাণিজ্য প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ইউরোপে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ফ্রান্স এবং এশিয়ায় জাপানের উদ্ভব ঘটে। যুদ্ধকালে ব্রিটেনের রাষ্ট্রীয় ঋণ ১২ গুণ বেড়ে যায়। বিদেশে পুঁজির বিনিয়োগ ২৫% কমে যায়।
ইংল্যান্ড যুদ্ধে ৭ লাখ ৪৩ হাজার নাগরিককে হারায়, ১৬ লাখ ৯৩ হাজার জন আহত হয়। যুদ্ধে ফ্রান্সের অবস্থাও শোচনীয় রূপ ধারণ করে।
ফ্রান্সের ১৩ লাখ ২৫ হাজার যুবক (যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রতি ছয় জনে একজন) মৃত্যুবরণ করে, ২৮ লাখ আহত এবং ৬ লাখ মানুষ পঙ্গু হিসেবে যুদ্ধ থেকে ফেরত আসে।
ফ্রান্সের হয় পূর্বাঞ্চলের শিল্প ডিপার্টমেন্টগুলো শত্রু কবলিত ছিল। কয়লা উত্তোলন ৪০.৮ থেকে ২৬.২ শতাংশে নেমে আসে। ইস্পাত উৎপাদন ৪.৭ থেকে ১.৮ মিলিয়ন টনে নেমে আসে।
জাতীয় সম্পদের চারভাগের একভাগ ধ্বংস হয়ে যায়। যুদ্ধের আগের চেয়ে প্রয়োজনীয় নিত্য দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য ৬ থেকে ৭ গুণ বেড়ে যায়। কৃষি উৎপাদনকে সচল করার মত পশু তখন ফ্রান্সে জীবিত ছিল না।
Conclusion:
রাশিয়া, ইতালি, অস্ট্রো-হাঙ্গেরি, বলকান রাষ্ট্রগুলোসহ সব দেশের ইহাই অনুরূপ শোচনীয় ছিল। রাশিয়া এই ধ্বংসযজ্ঞের ধকল সইতে পারে নি। সেখানে ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মার্চে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়, একই বছর অক্টোবর মাসে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ | ঘটনাপ্রবাহ
ধন্যবাদ। অনেক তথ্য জানতে পারলাম। এই ভয়াবহ যুদ্ধের গল্প যদিও সকলেরই জানা। তবুও জানা গেলো কিভাবে শুরু হলো ধ্বংস আর কি করেই ৩৪ টি দেশ জড়িয়ে পড়ল। দুঃখজনক।
ধন্যবাদ পাশে থাকার জন্য । আরো আরো বেশি তথ্য জানতে আমাদের সাথে থাকুন এবং শেয়ার করে বন্ধুদের জানার সুযোগ করে দিন।