স্টেথস্কোপ চিনেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভারি দুষ্কর । কেননা স্টেথস্কোপ খুবই পরিচিত একটি যন্ত্র । এখন যেমন প্রতিটা ডাক্তারের গলায় স্টেথস্কোপ ঝুলতে দেখা যায়, আগে কিন্তু এমনটা ছিল না। এই অতি প্রয়োজনীয় যন্ত্রটি আবিষ্কৃত হওয়ার গল্পটিও অসাধারন । আসুন ডা. শুভাগত চৌধুরী থেকে জেনে নিই স্টেথস্কোপ আবিষ্কারের ইতিহাস ।
কাগজের চোঙা থেকে স্টেথস্কোপ
স্টেথস্কোপ আবিষ্কারের কাহিনী |
স্টেথস্কোপ কী ?
স্টেথস্কোপ হলো বুক পরীক্ষা করার যন্ত্র । যে যন্ত্রের সাহায্যে প্রাণী দেহের অভ্যন্তরীন নানা শব্দ শ্রবণ করা যায় তাকে স্টেথস্কোপ বলে ।
স্টেথস্কোপ একটা গ্রিক শব্দ। স্টেথো মানে হচ্ছে বুক; আর স্কোপিন অর্থ পরীক্ষা করা। তাহলে এর পুরো মানে দাঁড়াল— বুক পরীক্ষা করার যন্ত্র। একটু প্রাঞ্জল বাংলায় একে বলা যায়— হৃদবীক্ষণ যন্ত্র।
অর্থাৎ, স্টেথস্কোপ হলো এমন একটি ডাক্তারী যন্ত্র, যা মানুষ কিংবা প্রাণীর শরীরের ভিতরের শব্দ যেমন, প্রাণিদেহের হৃদস্পন্দন, নি:শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনার জন্য ব্যবহৃত হয় ।
এছাড়াও অন্ত্র, ধমনী এবং শিরার রক্ত বয়ে চলার শব্দ শোনার জন্যও ব্যবহৃত হয় স্টেথস্কোপ ।
স্টেথস্কোপ আবিষ্কারের কাহিনী
১৮১৬ সাল। ইউরোপের ন্যাকার হাসপাতালের থিওফিল লেনেক নামে একজন ডাক্তার একদিন এক ভারি মজার বিপদে পড়েছিলেন; আর একে কেন্দ্র করে খুব দামি একটি জিনিস আবিষ্কৃত হল। সেই ঘটনাই বলছি।
একদিন বিকেলবেলা তিনি তাঁর অফিস-ঘরে চুপ-চাপ বসে আছেন ; হঠাৎ তাঁর কাছে খবর এল একজন নতুন রোগিণী ভর্তি হয়েছে। হৃদরোগের সব লক্ষণই আছে। এক্ষুণি গিয়ে পরীক্ষা করতে হবে।
ডা. লেনেক সেখানে গেলেন, কিন্তু গিয়ে যা দেখলেন, তাতে তো তাঁর আক্কেল-গুড়ম। রোগিণী তরুণী কিন্তু বিচ্ছিরি মোটা।
একটি চেয়ারের উপর বসে তিনি হাঁপাচ্ছেন আর একজন ঝি একটা হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে। শরীরের মৃদু উঠা-নামার সাথে সাথে চেয়ারের পায়াগুলোও যেন দারুণ যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠছে!
এখন কথা হল, হৃদপিণ্ড পরীক্ষা করতে হলে রোগিণীর বুকে কান লাগাতে হবে; কারণ তখনকার দিনে হৃদপিণ্ডের স্পন্দন শোনার ঐ একটি মাত্র উপায় ছিল। কিন্তু তাঁর হল মহাবিপদ!
এমনিতেই মেয়েদের বিশেষ করে যুবতীদের তিনি দারুণ ভয় করতেন। আর এখন এই বিপুলা তরুণীর বুকে কান লাগিয়ে হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি শোনা।
এর আগে নিজেরই বুকের ঢিপ ঢিপ শুরু হয়ে গেল তাঁর। ভাবলেন : উঃ কি ভীষণ মোটা মেয়েরে বাবা।
আর মনে মনে দুনিয়ার তাবৎ মোটা মেয়েদের গাল-মন্দ করতে লাগলেন। কিন্তু তা করে যদি পার পাওয়া যেত, তাহলে তো ভালোই হতো।
কিন্তু হৃদরোগের রোগী। তাকে তো যেমন করেই হোক পরীক্ষা করতেই হবে। তাহলে উপায়? লেনেক মহা ভাবনায় পড়লেন।
এদিকে ভাবতে ভাবতে কখন যে তিনি রোগী-পরীক্ষার ঘর পেরিয়ে কাছের একটি পার্কে ঢুকে পড়েছেন টেরই পান নি। তখন সবেমাত্র স্কুল ছুটি হয়েছে। অগুনতি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ছুটোছুটি হুড়োহুড়ি করছে পার্কের ঘাস-ছাওয়া মাঠে।
হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল পার্কের যে কোণে খেলা করছিল চারজন ছেলে সে দিকে। ওরা একটি কাঠের নাগরদোলার চারদিকে জড়ো হয়েছে।
একটি ছেলে কাঠের গায়ে একদিকে একটি লোহার পিন দিয়ে খুব জোরে জোরে আঁচড় কাটছে; আর অন্যদিকে বাকি ছেলেরা কান ঠেকিয়ে শুনছে।
হঠাৎ ওরা চেঁচিয়ে উঠল— ‘কি মজা! কি মজা আঁচড়ের শব্দটা কি পরিষ্কার আর জোরে শোনা যাচ্ছে।’ আনন্দে ওরা লাফিয়ে উঠল।
যে ছেলেটি এতক্ষণ আঁচড় কাটছিল, সে তার সাথীদের একজনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘জন, তুমি এবার এদিকে এস। আমার শুনতে হবে না বুঝি?
শোনার পালা যখন শেষ হল, তখন ওরা সবাই এক জায়গায় গোল হয়ে বসল। তারপর জল্পনা-কল্পনা করতে লাগল, ‘ভাইতো। শব্দটা এত চমৎকার শোনা যাচ্ছে।’
লেনেক এতক্ষণ আড়াল থেকে ছেলেদের কাণ্ড-কারখানা দেখছিলেন, আর মনে মনে হাসছিলেন। এবার তিনি এগিয়ে ছেলেদের কাছে গেলেন।
‘ছেলেরা শোন, তোমরা নিশ্চয়ই এতক্ষণ ভাবছিলে কেন শব্দটা এত জোরে শোনা যাচ্ছে— তাই না? কিন্তু আসলে এটা খুব সোজা ব্যাপার।’
তাঁকে ঘিরে সবাই তখন চিৎকার করে উঠল ‘বলুন না সে ব্যাপারটা।
“তাহলে শোন।’ লেনেক একটু হেসে শুরু করলেন—
‘বিজ্ঞানের এক মৌলিক তত্ত্ব এ ব্যাপারটা— শব্দ যখন কোনো নিরেট জিনিসের মধ্য দিয়ে যায়, তখন এটা বহুগুণে বেড়ে যায়। এটা…. হঠাৎ চুপ করে গেলেন তিনি।
তারপর আবার আনমনে হাসপাতালের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন …… হঠাৎ কি হল তাঁর? ছেলেরা কেমন হতভম্ব হয়ে যায় । শুধু তাদের মুখ দিয়ে বেরোয় ‘আশ্চর্য’।
লেনেকের মাথায় তখন অন্য চিন্তা। ভাবছেন, ‘ছিঃ! আমি কি বোকা! এই সোজা কথাটা আমার মাথায় আসছিল না।
শব্দ যখন কোন নিরেট জিনিসের মধ্যে দিয়ে যায় তখন তা বহুগুণে বেড়ে যায়; এ ছাড়া যদি শব্দকে একটি ফাঁপা চোঙার মধ্যে আবদ্ধ করে প্রবাহিত করা যায় ……
মনে মনে একটি মজার মতলব আঁটলেন তিনি……. হাসপাতালে এসে নার্সকে ডেকে বললেন “আমার জন্য কিছু কাগজ নিয়ে এস
‘কাগজ?’ নার্সটি কেমন অবাক হয়ে যায়।
“হ্যাঁ। নিয়ে এসো জলদি।
তারপর এক গাদা কাগজ গুটিয়ে তিনি একট ফাঁপা চোঙার মতো বানালেন। সেই কাগজের চোঙা হাতে করে রোগীণীর ঘরে উপস্থিত হলেন।
আরো পড়ুন… আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল | টেলিফোন আবিষ্কারের ইতিহাস
ডা. লেনেক কাগজের স্টেথস্কোপ দিয়ে রোগী পরিক্ষা করছেন |
সবাই ভাবল, এ আবার কি অদ্ভুত খেয়াল ডা. লেনেকের। তিনি কিন্তু গম্ভীরভাবে রোগিণীর দিকে এগুলেন। তারপর সেই কাগজের চোঙার একদিকের খোলামুখ তার বুকে বসালেন আর অন্যদিকে নিজের কান চেপে ধরলেন।
হৃদপিণ্ডের স্পন্দন শোনার পর ফুসফুস দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও তিনি শুনলেন। আনন্দে তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল।
শব্দগুলো এত জোরে শোনা যাচ্ছিল যে মনে হল যেন তাঁর কানে কানে ওরা কথা বলছে । এরপর নতুন বানানো চোঙটি নিয়ে দৌড়ে তিনি রোগীদের ওয়ার্ডে গেলেন।
একজনের পর একজন পরীক্ষা বলে চললেন এই নতুন উপায়ে। উত্তেজনায় তাঁর শরীর থরথর করে কাঁপছিলো। নার্স-ডাক্তার হাসপাতালের সব লোক তাঁর এই আজব কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গেলেন।
সবাই বলাবলি করতে লাগল— ডা. লেনেক কি হঠাৎ পাগল হয়ে গেলেন?’ তাঁর কিন্তু সেদিকে মোটেই খেয়াল নেই। নতুন আবিষ্কারের নেশায় তখন তিনি মেতে উঠেছেন।
নিউমোনিয়ার রোগী। কাগজের চোঙা দিয়ে লেনেক রোগীর শ্বাস প্রশ্বাসের ভারি-মোটা শব্দ শুনলেন।
তারপর একটা এপায়েমা (EMPYEMA) রোগী। রোগী তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি দেখছেন ডাক্তার।
চোঙা দিয়ে অদ্ভুত কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ শোনা গেল। রোগী যেন নাকি সুরে কথা বলছে— অনেকটা ছাগলের ভ্যাঁ ভ্যাঁ শব্দের মতো।
লেনেক পরে এ শব্দের নাম দিয়েছিলেন এগোফোনি (aegophony) পরের টা যক্ষ্মারোগিণী।
আরেকটা মজার শব্দ শুনতে পেলেন তিনি। মেয়েটা ফিসফিসিয়ে উঠল, ‘এ যন্ত্রটা তো আগে দেখিনি ডাক্তার।’
লেনেকের মনে হল যেন শব্দটা গলা দিয়ে না এসে সোজা রোগিণীর বুক থেকে উঠে এসেছে। শব্দটা খুব স্পষ্ট তো বটেই, এ ছাড়া আরও মনে হলো যেন কেউ তাঁর কানে মুখ লাগিয়ে কথা বলছে।
লেনেক এর নাম দিলেন হুইসপারিং পেকটোরিলোকুই (Whispering Pectoriloquy) |। এরকম শব্দ শুনতে পাওয়ার মানে কি? সে ব্যাপারটাই বলছি।
ফুসফুসের নানান রোগে নানান শব্দ
আমাদের শ্বাসযন্ত্রটা একটা নলের মতো। এর প্রথম অংশে থাকে স্বরযন্ত্র বা শব্দের বাক্স (Larynx) তারপর শ্বাসনালীর শুরু।
এটা আবার একটু নিচে গিয়ে দু’ভাগে ভাগ হয়েছে। এই দুই নালীর নাম ব্রঙ্কাই (Bronchi)। ব্রঙ্কাই ফুসফুসে গিয়ে শেষ হয়েছে।
ফুসফুস স্পঞ্জের মতো ফোঁপরা। সেটাকে ঢেকে রেখেছে একটা পাতলা আবরণ— প্লুরা (Pleura)।
আমাদের বুকের পাঁজরা আর মাংসপেশী একটা দেয়ালের মতো ফুসফুসকে ঘিরে রাখে। আর তাই শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ বুকের দেয়ালের স্টেথসকোপ লাগিয়ে সহজেই শোনা যায়।
আমরা যখন কথা বলি তখন স্বরযন্ত্রে যে শব্দ তৈরি হয় তা আবার শ্বাসনালী— ফুসফুস বেয়ে বুকের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়।
এমনি বুকে কান লাগিয়েই সেই ভোঁ ভোঁ শব্দ শোনা যায়। ডাক্তারি ভাষায় একে বলা হয় (Vocal Resonance) বা স্বরের প্রতিধ্বনি।
ফুসফুসের নানান রোগে এই ‘স্বরের প্রতিধ্বনি‘ও হয় নানা রকমের। ফুসফুসের বিভিন্ন রকমের রোগে বিভিন্ন ধরনের শব্দ স্টেথসকোপ দিয়ে শোনা যায়।
কি করে তা সম্ভব হল ? উদাহরণস্বরূপ,
প্রথম, এপায়েমা রোগীর কথাই ধরা যাক। আগে বলেছি, ফুসফুস একটি পাতলা আবরণে (Pleura) ঢাকা থাকে। সে আবরণের আবার দুটো ভাঁজ থাকে। সে ভাঁজের মধ্যে যখন পুঁজ মেশানো পানি জমা হয় তখন তাকে ‘এমপায়েমা’ বলে।
সেই পানির চাপে ফুসফুস সংকুচিত হয়ে যায়। তাই এই নতুন মাধ্যমের মধ্য দিয়ে—মানে সংকুচিত ফুসফুস ও পানির মধ্য দিয়ে শব্দ সমানভাবে ও একই গতিতে যেতে পারে না ।
আর তাই বুকের দেয়ালে প্রতিধ্বনিটি এরকম কাঁপা কাঁপা নাকি শব্দের মতো শোনা যায়। একেই বলে এগোফোনি।
আবার যক্ষ্মারোগে ফোঁপরা ফুসফুস কঠিন হয়ে যায়; আর এটা সবাই জানে, কঠিন জিনিসের মধ্য দিয়ে শব্দের পরিবহন খুব ভালো হয়।
এছাড়া এ রোগে ফুসফুসে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়। তাই কোনো ব্রহ্মাসের যদি সে গর্তের সাথে যোগাযোগ হয়ে যায়, তাহলে স্বরের ধ্বনির পরিবহন আরও বেড়ে যায়।
তখন মনে হয় শব্দ যেন ঠিক বুক থেকে সরাসরি কানে এসে পৌঁছাচ্ছে। খুব আস্তে কথা বললেও তা খুব পরিষ্কার ও জোরালো শোনা যায়। এরই নাম হুইসপারিং পেকটোরিলোকুই।
এবার আসল কাহিনীতে ফেরা যাক।
স্টেথস্কোপ ও ডা. লেনেক
ডা. লেনেক এই কাগজের চোঙা দিয়ে পরপর অনেকগুলো রোগী পরীক্ষা করে তাঁর চমৎকার আবিষ্কারের সাফল্য সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হলেন।
কিন্তু এই কাগজের চোঙটি সবসময় ব্যবহারের জন্য খুব উপযোগী মনে হল না। তাই এর বদলে একটা ফাঁপা কাঠের নল তৈরি করে নিলেন তিনি।
সেই কাঠের ‘নলটি’ এরপর তাঁর চিরসঙ্গী হয়ে গেল।
আরও পড়ুন… মাদাম কুরি | ভৌতবিজ্ঞান আর রসায়নে এক অন্যন্য উজ্জ্বল নক্ষত্র
স্টেথস্কোপ এর নামকরন
কিন্তু নাম? যন্ত্রটার একটা নামও তো দরকার। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর তিনি তাঁর প্রিয় যন্ত্রটার নামকরণ করলেন— স্টেথসকোপ’। স্টেথসকোপ একটা গ্রিক শব্দ।
স্টেথো মানে হচ্ছে বুক; আর স্কোপিন অর্থ পরীক্ষা করা। তাহলে এর পুরো মানে দাঁড়াল— বুক পরীক্ষা করার যন্ত্র। একটু প্রাঞ্জল বাংলায় একে বলা যায়— হৃদবীক্ষণ যন্ত্র।
তবে আজকাল ডাক্তারদের গলায় যে যন্ত্রটা ঝুলতে দেখা যায়, তা হচ্ছে আধুনিক স্টেথসকোপ।
বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে কাঠের নলটি বদলে ক্রোমিয়াম ও রবারের তৈরি এই আধুনিক স্টেথসকোপে পরিণত হয়েছে।
এই যন্ত্রে যে দুটো নল রয়েছে, তার আসল কাজ হল— বুকের খুব মৃদু শব্দকে অনেকটা জোরালো করে তোলা।
নলের অল্প জায়গার মধ্যে খানিকটা শব্দ আটকা পড়ে যায় বলেই মৃদু শব্দকে জোরালো শোনা যায়।
এরপর চলল শুধু আবিষ্কার আর আবিষ্কার। ‘কাঠের নল যন্ত্রটি’ দিয়ে হাজার হাজার রোগীর বুকের শব্দ শুনে তিনি বুঝলেন যে এই উপায়ে রোগ নির্ণয় করা সহজ।
মাত্র তিন বছরে তিনি প্রায় শব্দগুলোর রোগ বিশেষে শ্রেণীভাগ করে ফেললেন আর প্রত্যেক শব্দকেও আলাদাভাবে বর্ণনা করলেন।
যক্ষ্মারোগের উপর তিনি বিশেষভাবে গবেষণা করেন। তিনি বললেন, যক্ষ্মারোগ সম্ভবতঃ ছোঁয়াচে এবং এ রোগের মূলে আছে কোনো এক বিশেষ ধরনের জিনিস।
তাঁর নতুন ধারণাগুলো সবাইকে জানাবেন, ভাবলেন তিনি। একটি বই লেখার পরিকল্পনাও সাথে সাথে করে ফেললেন।
কিন্তু বেশি পরিশ্রমে তাঁর শরীর ইতোমধ্যেই ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল। তবু অসীম মনোবলকে সম্বল করে শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর সংকল্পে জয়ী হলেন।
বিভিন্ন শব্দের কার্যকারণ ও রোগের সাথে এর যোগাযোগ সম্বন্ধে একটি বই বেরুলো তাঁর।
ডা. লেনেক ও ডা. ব্রুসেস এর দ্বন্দ
ডা. লেনেক এর আবিষ্কার চিকিৎসা জগতে এক নতুন দরজা খুলে দিয়েছিল । কিন্তু তা নিয়ে ডা. ব্রুসেস নামে প্যারিসের এক ডাক্তারের সাথে তাঁর ভীষণ ঝগড়া বাধল।
ব্রুসেসের মতে দেহের কোনো অংশে কম-বেশি উত্তেজনার ফলে রোগের সৃষ্টি হয়। তিনি বললেন, সব রকম রোগেরই রাজা হচ্ছে পেটের গোলমাল’। আর চিকিৎসা বলতে ভালো খাওয়া-দাওয়া আর রক্তমোক্ষণ (Blood letting) |
এদিকে ডা. লেনেক বললেন, বুকের রোগ সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের। এর সাথে দেহের উত্তেজনার কোনো সম্পর্ক নেই।
স্টেথসকোপের মধ্য দিয়ে ফুসফুস ও হৃদপিণ্ডের কাজকর্মের শব্দ শুনে সহজেই এর স্বাতন্ত্র্য ধরা যায়। কিন্তু কেউ তা মানল না।
ব্রুসেস হচ্ছেন প্যারিসের পুরোনো আর ঝানু ডাক্তার নবীন ডাক্তার লেনেকের এই ‘আজগুবি কথা’ কেউ বিশ্বাস করবে কেন?
যাহোক, দুজনের খুব তর্কাতর্কি বাধল। দুজনেই দুজনের বিরুদ্ধে সমানে বক্তৃতা দিয়ে চললেন। কিন্তু মানুষ তাঁদের বক্তৃতার কথা অতো তলিয়ে দেখল না।
বিরাট বপু ব্রুসেসের বাজখাই গলার আওয়াজ শুনেই লোকে আহ্লাদে আটখানা। বক্তৃতার মাঝে মাঝে বোকা লোকদের হাততালিতে সভাস্থল মুখর হয়ে যায়; আর ব্রুসেস বীরপুরুষের মতো ঘাড় অল্প কাত করে জনতার সরব অভিবাদন গ্রহণ করেন।
আর ডা. লেনেকের কপাল মন্দ। এমনিতেই তিনি দেখতে ছিলেন বেঁটে খাটো আর রোগা-পাতলা। এর উপর তাঁর গলার আওয়াজটাও ছিল কেমন মিনমিনে ধরনের।
অস্তমিত এক প্রতিভা ডা. লেনেক
নিন্দা-বিদ্রূপ আর কতগুলো রসালো মন্তব্যই ডা. লেনেকের কপালে জুটল। তামাম শহর এই মজার ব্যাপার নিয়ে সরগরম হয়ে উঠল।
অবস্থা শেষ পর্যন্ত এমন দাঁড়াল, প্যারিসের লোকজন তাঁকে প্রকাশ্যে অপদস্থ করতে শুরু করল। কিন্তু সব কিছু সহ্য করেও তিনি তাঁর মতবাদে অটল রইলেন। পাক্কা পাঁচটি বছর তিনি এই বাকযুদ্ধ চালিয়ে গেলেন।
কিন্তু এর পরেও মানুষের কল্যাণের জন্য যুদ্ধ করেও তিনি মানুষের কাছ থেকে পেলেন একরাশ নিন্দা ও গঞ্জনা।
অসুস্থ শরীরের সাথে সাথে মনের যে বলটুকু এতদিন তিনি জিইয়ে রেখেছিলেন, তাও হারিয়ে গেল। তিনি বুঝলেন, এই পৃথিবীতে তাঁকে দেখার কেউ নেই তিনি একা– দারুণ একা।
আবিষ্কারের নেশায় তিনি এতই মশগুল ছিলেন যে এতদিন তিনি নিজেকে নিয়ে একবারও ভাবেন নি। তাঁর ক্লান্ত-বিধ্বস্ত দেহ-মন একটু শান্তির আশায় পাগল হয়ে উঠল……..
প্যারিসে মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় তিনি যে বাড়িতে থাকতেন, তার মালিক ছিলেন এক বিধবা মহিলা— নাম মাদাম আর্গো।
বেঁটে, আপন ভোলা এই ডাক্তারটিকে আর্গো যেন মনের অজান্তেই ভালবেসে ফেলেছিলেন। তাঁর অদৃশ্য স্নেহের শাসন সব সময় ঘিরে রাখতে লেনেককে।
শেষ পর্যন্ত সেই শাসনের বাঁধনেই আটকা পড়লেন তিনি। ১৮২৪ সাল। এক শীতের সন্ধ্যায় তাঁদের দুজনের বিয়ে হয়ে গেল।
প্যারিসের লোকেরা এ নিয়ে খুব হাসাহাসি করল। অনেকে মন্তব্য করল : বুড়োকালে (লেনেকের বয়স তখন মাত্র চুয়াল্লিশ) ভীমরতি হয়েছে লোকটার।
কিন্তু কেউ বুঝল না– এ বয়সে বিয়ে করে জীবনের সব তিক্ততা, সব নির্জনতাকে তিনি ভুলতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু কি ব্যর্থ চেষ্টা তিনি করেছিলেন তা যদি তিনি আগে জানতেন! পরের বছরই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। রোগে ভুগে ভুগে তিনি দারুণ রোগা হয়ে গেলেন।
যে যক্ষ্মারোগের কারণ খুঁজতে গিয়ে শত শত রোগীর পাশে কাটিয়েছেন দিনের পর দিন— সেই যক্ষ্মা রোগ তিনি নিজেই যে কখন বাধিয়ে বসেছেন, টেরই পান নি।
প্রথম প্রথম অল্প জ্বর হ’ত— একটু পরিশ্রমেই দারুণ ক্লান্ত হয়ে পড়তেন তিনি ।
তারপর ……. একদিন কফের সাথে এক ঝলক তাজা রক্ত বেরিয়ে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল তাঁর বুঝলেন, তাঁর দিন শেষ হয়ে এল এবার কোনোমতে নিজেকে সামলে বিছানায় শুয়ে পড়লেন তিনি ।
ক্লান্ত পান্ডুর চোখের ইশারায় মাদাম আর্গোকে কাছে ডাকলেন নিজের কোলে তাঁর মাথাকে শুইয়ে দিলেন আস্তে আস্তে । সকল ক্লান্তি যেন জুড়িয়ে গেল লেনেকের ।
উঠল হঠাৎ…….. ……..
মাদাম কি যেন বলবার আশায় চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ফ্যাকাসে ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল থরথর করে সব ক্লান্তির সব ব্যথার ওপারে চলে গেলেন তিনি।
একটা ফুল, যে শুধু গন্ধই বিলিয়ে গেল অকাতরে । একটা প্রাণ, যে শুধু মানুষের কল্যাণই করে গেল সারাজীবন— এভাবেই হারিয়ে গেল।
আরও পড়ুন… গুলিয়েলমো মার্কনি | রেডিও আবিষ্কারের ইতিহাস
স্টেথস্কোপ আবিষ্কারক এর সংক্ষিপ্ত পরিচয়
জন্ম | রেনে-থিওফিল-হায়াসিনথে ল্যানেক ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৭৮১ কুইম্পার, ফ্রান্স |
---|---|
মৃত্যু |
১৩ আগস্ট ১৮২৬ (বয়স ৪৫)
প্লোরে, ফ্রান্স |
লেখাপড়া | University of Paris |
পরিচিতির কারন | স্টেথোস্কোপ আবিষ্কার |
কিছু সাধারণ প্রশ্নত্তর
স্টেথস্কোপ কে আবিষ্কার করেন ?
স্টেথস্কোপ আবিষ্কার করেন ডা. রেনে থিওফিল হায়াসিনথে ল্যানেক । সংক্ষেপে ডা. লেনেক
স্টেথস্কোপ কত সালে আবিষ্কৃত হয় ?
স্টেথস্কোপ আবিষ্কৃত হয় ১৮১৬ সালে ।
বিশ্বের প্রথম স্টেথস্কোপ কি দিয়ে তৈরী ?
বিশ্বের প্রথম আবিষ্কৃত স্টেথস্কোপ তৈরী হয়েছিল কাগজের চোঙ্গা দিয়ে ।
স্টেথোস্কোপ এর কাজ কি ?
স্টেথোস্কোপ এর কাজ প্রাণী দেহের অভ্যন্তরীন নানান শব্দ যেমন হৃদস্পন্দন, শিরা, অন্ত্র, ধমনিতে রক্ত প্রবাহ, নি:শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দকে আরো জোরালোভাবে শুনতে সাহায্য করা।
স্টেথোস্কোপ অর্থ কী ?
স্টেথস্কোপ একটা গ্রিক শব্দ। স্টেথো মানে হচ্ছে বুক; আর স্কোপিন অর্থ পরীক্ষা করা। তাহলে এর পুরো মানে দাঁড়াল— বুক পরীক্ষা করার যন্ত্র। একটু প্রাঞ্জল বাংলায় একে বলা যায়— হৃদবীক্ষণ যন্ত্র।
শেষ কথা
আজকাল রোগ ধরার জন্য কত আধুনিক উপায় আবিষ্কৃত হয়েছে, নতুন নতুন যন্ত্রপাতিতে ভরে গেছে সারা জগৎ । কিন্তু এর জন্য আমরা সবাই ঋণী এই অবহেলিত ডাক্তার লেনেকের কাছে । যিনি রোগ নির্ণয় বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক নতুন পথের সন্ধান দিয়ে গিয়েছিলেন।
তথ্যসুত্র
- চিকিৎসা বিজ্ঞানে আবিষ্কারের কাহিনী By শুভাগত চৌধুরী
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC1570491/
- https://lemelson.mit.edu/resources/rene-laennec
- https://www.oxfordreference.com/view/10.1093/oi/authority.20110803100047595
- https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/17048358/#:~:text=Rene%20Theophile%20Hyacinthe%20La%C3%ABnnec%20(1781%2D1826)%20was%20a%20French,the%20observations%20made%20during%20autopsies.