
আজ আমরা সবাই পেনিসিলিন নামে একরকমের ওষুধের নাম জানি। পেনিসিলিনে আছে রোগজীবাণু ধ্বংস করার ক্ষমতা। কত যে রোগ এখন পেনিসিলিন দিয়ে সারিয়ে তোলা হচ্ছে তার হিসেব নেই। কিন্তু এমন একটা সময় ছিল যখন পেনিসিলিনের কথা কেউ জানত না।
এই উপকারী ওষুধটি আবিষ্কার করেছিলেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং নামে একজন স্কটিশ বিজ্ঞানী। তাঁর এই আবিষ্কারের জন্য সারা পৃথিবী তাঁর কাছে ঋণী। কোনোদিন কেউ তাঁকে ভুলতে পারবে না।
ফ্লেমিং ছিলেন দরিদ্র পিতামাতার সন্তান। স্কটল্যান্ডের লকফিল্ড অঞ্চলের এক ক্ষুদ্র গ্রামে ১৮৮১ সালের ৮ আগস্ট তাঁর জন্ম হয়। চাষির ঘরে জন্ম তাঁর। কাজেই আর্থিক অনটনের মধ্যেই ছেলেবেলা কেটেছে। তার উপর মাত্র সাত বছর বয়সে বাবার মৃত্যু হলে ফ্লেমিং খুব বিপদে পড়েন। নিরুপায় হয়ে ফ্লেমিং একটা জাহাজে চাকরি নেন। এসময় এক কাকার মৃত্যু হলে তাঁর কিছু সম্পত্তি পেয়ে যান ফ্লেমিং। তাঁর অর্থকষ্ট ঘোঁচে।
এবার তিনি লন্ডনে এসে পড়াশুনো চালিয়ে যেতে থাকেন এবং ১৯০২ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করে লন্ডনের সেন্ট মেরিজ মেডিক্যাল স্কুলে ডাক্তারি পড়তে শুরু করেন। ১৯০৬ সালে সেখান থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে ডিগ্রি পান। এসময় তাঁর পরিচয় হয় এডওয়ার্ড রাইট নামে তখনকার এক নামজাদা অধ্যাপকের সঙ্গে। রাইট তখন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে টাইফয়েডের টিকা নিয়ে গবেষণা করছিলেন।
তাঁর উপদেশে ফ্লেমিং প্রথমে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবাণু নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং কয়েক বছর পর সেন্ট মেরিজ হাসপাতালে গবেষণা করতে থাকেন। একই সঙ্গে ফ্লেমিং ওই মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপনাও করেন।
একদিন তাঁর গবেষণাগারে হঠাৎই একটা ব্যাপার দেখে তিনি অবাক হয়ে যান। ফ্লেমিং তখন একরকম ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু নিয়ে গবেষণা করছিলেন। কতকগুলো পাত্রে ওই জীবাণু রাখা ছিল। একদিন তাঁর নজরে আসে যে, তার মধ্যে একটি পাত্রের জীবাণু মারা গেছে।
অন্য পাত্রগুলোর জীবাণু যেমন বেঁচে ছিল তেমনই রয়েছে। তাহলে ওই পাত্রের জীবাণুগুলো মরল কেন? তিনি দেখলেন ওই পাত্রের গায়ে ছত্রাক জমেছে। তবে কি ছত্রাকের জন্যেই জীবাণু মরল? যেমনি কথাটা মনে হওয়া অমনি শুরু হয়ে গেল পরীক্ষা। পরীক্ষায় দেখা গেল ওই ছত্রাকের মধ্যে পেনিসিলিন
নামে একরকম পদার্থ রয়েছে যার আছে জীবাণু মেরে ফেলার ক্ষমতা। যতবারই ওই ছত্রাক আর জীবাণুকে একসঙ্গে রাখা যায়, ততবারই জীবাণু মরে যায়। এ থেকেই ফ্রেমিং আবিষ্কার করেন পেনিসিলিন। ইঁদুর খরগোশ প্রভৃতি প্রাণীর শরীরে পেনিসিলিন ঢুকিয়ে তিনি দেখলেন যে তাদের শরীরের ক্ষত সেরে যাচ্ছে। ১৯২৯ সালে তিনি তাঁর এই বিরাট আবিষ্কারের কথা একটি বিজ্ঞাপন পত্রিকায় প্রকাশ করলেন।
তবে পেনিসিলিন তো শুধু আবিষ্কার করলেই হবে না। মানুষের শরীরে তাকে প্রয়োগ করে নানা রোগের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে হলে ছত্রাক জাতীয় জিনিসের ভেতর থেকে পেনিসিলনকে বার করতে হবে, তাকে শোধন করতে হবে। কিছুদিন পর ডা. বরিস চেইন ও ডা. ফ্লোরি নামো দু’জন গবেষক সেই কাজটা করে ফেললেন। এঁরা গবেষণা চালিয়ে কিছুকালের মধ্যেই পেনিসিলিন তৈরি ও শোধন করার উপায় বার করে ফেললেন।
এবার লন্ডনের পুলিশ হাসপাতালের রোগীদের উপর পেনিসিলিন ওষুধ হিসেবে প্রয়োগ করা হল। রোগীরা তার ফলে সেরে উঠতেই চারদিকে ফ্লেমিঙের জয়জয়কার উঠল।
কয়েক বছর পরে ১৯৪৫ সালে এই বিরাট আবিষ্কারের জন্য ফ্লেমিংকে নোবেল পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়। ১৯৫৫ সালের ১১ মার্চ লন্ডনে ফ্লেমিংয়ের মৃত্যু হয়।